টুইটারে ইসরায়েলের মিথ্যার বেসাতি

রচনায় : বেলেন ফার্নান্দেজ
ইসরায়েল সেনাবাহিনীর টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে গত ১৪ মে একটি পপ কুইজ ভিডিও পোস্ট করা হয় সেখানে। ভিউয়ারদের কল্পনা করতে বলা হয়, ইসরায়েল সেনাবাহিনীর সদস্য এবং গাজা থেকে রকেট ছোড়ার প্রত্যুত্তরে তাদের কী করা উচিত, সেটি যেন তারা জানায়। সেখানে ‘এ’ এবং ‘বি’—এই দুটি বিকল্প উত্তর রাখা হয়েছে। উত্তর ‘এ’-তে বলা হয়েছে : ‘কিছুই না (সন্ত্রাসীদের ইসরায়েলি শহরগুলো ধ্বংস করতে দেওয়া হোক)। উত্তর ‘বি’-তে বলা হয়েছে, রকেট ছোড়া সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া।
ইসরায়েল সেনাবাহিনীর মতে, একটিই সঠিক উত্তর আছে। সেটি হলো “বি”।

বাস্তবে যা ঘটছে, তার আলোকে বিচার করে বলা যায়, সেনাবাহিনী ‘সি’ শীর্ষক আরেকটি অপশন রাখতে পারত। সেই অপশনের ভাষা হতে পারত, ‘ইসরায়েল ৭৩ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালানোয় এবং ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে তাদের উচ্ছেদ করা অব্যাহত রাখায় ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের শহরগুলোকে ধ্বংস করতে অক্ষম কিছু রকেট ছোড়ায় ফিলিস্তিনিদের ঝাড়ে বংশে শেষ করে দিতে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হোক।’ এই ধরনের ভাষাসংবলিত একটি ‘সি’ অপশন থাকলে সেটিই বরং অনেক বাস্তবমুখী ‘পপ কুইজ’ হতো।
১০ মে শুরু হওয়া ইসরায়েলের আক্রমণে এ পর্যন্ত আড়াই শ জনের কাছাকাছি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। এঁদের মধ্যে ৬৬ জনই শিশু। একদিকে হামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে তারা মারছে, অন্যদিকে সেই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে নানা সামরিক বাহিনীর টুইটার অ্যাকাউন্ট এবং অন্য প্রচারযন্ত্রে নানান ধরনের প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ওই টুইটার অ্যাকাউন্টের ফলোয়ারের সংখ্যা ১৫ লাখ। এই অ্যাকাউন্ট থেকে যে প্রচার চালানো হয়, তাতে ইসরায়েলকে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখানো হয়। তারা দেখাতে থাকে আক্রান্ত এই ‘ভিকটিম’ নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আক্রমণকারীদের ওপর আঘাত হানে। তারা দেখাতে থাকে, ফিলিস্তিনে তারা যে গণহত্যা চালায়, তার নৈতিক বৈধতা রয়েছে।
ফিলিস্তিনে যে পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার তুলনায় ইসরায়েলের ক্ষতি হয়েছে খুবই কম। কিন্তু ইসরায়েল সেনাবাহিনীর টুইটারে দেশটিতে বোমা পড়ার আগে বাজানো সাইরেনের যে গ্রাফিক চিত্র দেওয়া আছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।
১১ মে তাদের টুইটারে বলা হয়, এই সাইরেনের আওয়াজ শুনে কল্পনা করুন, এর মধ্যে আপনাকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। তাদের টুইটারে অসংখ্যবার ‘আপনি কল্পনা করে দেখুন’ কথাটা পাবেন। তারা ভিউয়ারদের ভয়াবহ কোনো কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, যে রাজ্যে হামাসের হামলার আতঙ্কে মানুষের পক্ষে বাস করা অসম্ভব। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় ধসে পড়া ভবনের জঞ্জাল থেকে ছয় বছরের শিশু শুজি এশকোনতানাকে যখন টেনে বের করা হলো, সে যখন তার চার ভাই-বোনের ছিন্নভিন্ন লাশ দেখল, তখন তার কী অবস্থা হচ্ছিল, তা তারা কল্পনা করতে বলে না।
ইসরায়েল সেনাবাহিনী একটি টুইটে বলেছে, ‘কল্পনা করুন, এটিই আপনার বাস্তবতা’। আরেকটিতে বলেছে, ‘কল্পনা করুন, এটি যদি ওয়াশিংটনে হতো! এটি যদি প্যারিসে হতো! এটি যদি লন্ডনে হতো!’
এই সব ক্যাপশনের সঙ্গে হামাসের ছোড়া রকেটের ছুটে আসা এবং আতঙ্কিত ইসরায়েলিদের ছোটাছুটির ভিডিও চিত্র জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই গাজায় ভয়ংকর সব বোমা বাড়িঘরে পড়ছে। সেই বোমায় সবকিছু উড়ে যাওয়া দেখতে ফিলিস্তিনিদের কল্পনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে না।
১৮ মে পোস্ট করা একটি ভিডিও টুইটে ইসরায়েল সেনাবাহিনী বলেছে, ‘কল্পনা করুন, আপনার বাড়িটা সন্ত্রাসীরা ঘিরে রেখেছে’। তারা হয়তো ভুলে গেছে, ঠিক এই বিষয়টি ফিলিস্তিনিদের কল্পনা করতে হয় না। চারদিক থেকে তারা যেভাবে অবরুদ্ধ হয়ে আছে, তাতে তাদের কষ্ট করে কল্পনার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ইসরায়েলের ভাষ্য, সন্ত্রাসীরা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মিশে থেকে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যায়। সে কারণেই হয়তো তারা সাধারণ মানুষকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে নির্বিচার বোমা ফেলতে থাকে।
কয়েক দিন আগে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর টুইটার অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়, যেখানে একটি বসতি এলাকায় রকেট রাখা আছে—এমন দৃশ্য ছিল। টুইটে দাবি করা হয়, সেটি গাজার একটি এলাকা এবং সেই রকেট হামাসের। কিন্তু রয়টার্সের সাংবাদিক রাফায়েল সাত্তার ছবি বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দেন, ওই ছবিটা আসলে ২০১৮ সালের এবং সেটি ইসরায়েলের একটি সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ছবি। এরপরই ভিডিওটি টুইটার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আসলে ইসরায়েল এখন সরাসরি সামরিক অভিযানের পাশাপাশি ডিজিটাল যুদ্ধও চালাচ্ছে। সেই ডিজিটাল যুদ্ধে তারা যে প্রচার প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে, তার সঙ্গে সত্য ও বাস্তবতার যথেষ্ট দূরত্ব আছে।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
• বেলেন ফার্নান্দেজ যুক্তরাষ্ট্রের লেখক ও জ্যাকোবিন ম্যাগাজিনের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
প্রথম আলো, ২৬ মে ২০২১ প্রকাশিত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member