আমরা কেন আরবি শিখব

আমাকে যদি কেউ বলে এ পৃথিবীতে এখনও ডাইনোসর আছে তাহলে আমি হেসে উড়িয়ে দেব। যদি কেউ ছবি দেখায় তাহলে বলব ফটোশপ!
যদি একটা ভিডিও এনে হাজির করে?
জুরাসিক পার্ক নামের চলচ্চিত্রের দৌলতে আমরা জানি সেটাও বানানো সম্ভব।
কিন্তু যদি আমার কাছের আপন কোন মানুষ যাকে আমি বিশ্বাস করি সে ডাইনোসরগুলো নিজের চোখে দেখে আসে? সে ছবি-ভিডিও দেখালে কিছুটা হয়ত বিশ্বাস করব।
যদি এমন হয় আমি নিজেই সে সাগরের মাঝে পাহাড় ঘেরা সে দ্বীপটাতে গেলাম। চোখের সামনে বড় বড় ডাইনোসর দেখলাম, তাদের গর্জন শুনলাম। তখন কি আমি অবিশ্বাস করব? ডাইনোসরগুলোর সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াব—যে অতীতের এ বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলো সত্য নয়—আমার চোখের ভুল, আমাকে কিচ্ছু করবে না। বিশাল সব সাপ আর ভয়ংকর সব উড়ন্ত সরীসৃপের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত খোলা রাখব? জীবনের মায়া আছে এমন কেউ এমন কিছু করবে না।

আল্লাহ কুর’আনে জাহান্নামের যেসব শাস্তির কথা বলেছেন যেটা নিজেকে মুসলিম বলে দাবীকারী অনেকেই বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে জাহান্নামের আগুন ডাইনোসরের গালগল্পের মতই। কেন? তারা তো নিজের চোখে জাহান্নাম দেখেনি। এজন্য দুনিয়াতে কোনো খারাপ কাজ করার সময় এদের বুক কাঁপে না, হাত থামে না।

কিন্তু পৃথিবীটা তো সবসময় এমন ছিল না। এমন তো মানুষ ছিল যারা নির্জন ঘরে আল্লাহর শাস্তিকে ভয় পেয়ে পাপ থেকে থমকে গেছে। এমন মানুষ তো এখনও আছে যাদের কাছে জাহান্নামের বর্ণনা এতটাই জীবন্ত যে তারা কুর’আন শোনার সময় ভয়ে কাঁদতে থাকে, ক্ষমা চাইতে থাকে। এমন মানুষদের সাথে আমাদের এত বড় পার্থক্য হলো কীভাবে?

আল্লাহ আমাদের কাছে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ ﷺ কে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন। নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে তাকে বেশ কিছু মুযিজাও দিয়েছেন। যেহেতু পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত তিনি নবী হিসেবে থাকবেন তাই তাকে এমন একটা মুযিজা দিয়েছেন যা তিনি মারা গেলেও জীবন্ত থাকবে।
সেই মুযিজাটা হচ্ছে আল-কুর’আন, আল্লাহর নিজস্ব শব্দমালা। আল্লাহর শব্দমালা মানে? আল্লাহ সুবহানাহু পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষার কিছু শব্দকে বেছে নিলেন তার মনের ভাব মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য। এ শব্দমালার শক্তি কত? মানুষকে আশায়, কাঁদায়, ভাবায়। জীবন বদলে দেয়। ১৪০০ বছর আগে এ শব্দ শুনে মানুষ জীবন দিয়েছে আল্লাহর কালিমাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, আজও দিচ্ছে। হাসিমুখে দিচ্ছে।

বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা আল্লাহর সাথে মানুষের যে অতুলনীয় পার্থক্য, আল্লাহর শব্দমালার সাথে মানুষের সাহিত্যেরও সেই পার্থক্য। এ পার্থক্য এত এতই বড় যে মক্কার অবিশ্বাসী কাফের যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, মেরেছে ও মরেছে, তারা পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে—কুর’আন কোন মানুষের কথা নয়। সিজদার আয়াত শুনে তারা নিজের অজান্তে সিজদায় পড়ে গিয়েছে। তারা রাতের আঁধারে মুসলিমদের ঘরের পাশে লুকিয়ে তাই কুর’আন শুনত। তারা অহংকার বশত ইসলাম মানেনি কিন্তু কুর’আন যে আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে তা মানতে বাধ্য হয়েছিল। তারা সেইসব হতভাগা যারা ডাইনোসরদের স্বচক্ষে দেখেও গর্বভরে পৃথিবীতে চলতে চেয়েছিল।

কিন্তু আরবের কাফেররা যে কথা স্বীকার করে নিল, আমরা অধুনা মুসলিমরা সে কথা মানতে গররাজি কেন? কারণ, তারা যে ডাইনোসরগুলোকে স্বচক্ষে দেখেছিল আমরা তা দেখিনি। আমাদের সামনে কুর’আন আছে কিন্তু আমরা তা পড়ি না। বোঝার মতো করে পড়ি না। আমাদের কাছে কুর’আন কিছু ধ্বনি যার কোন অর্থ আমাদের কাছে নেই।

আল কুর’আনের একটি নাম আশ-শিফা কিন্তু কুর’আন আমাদের সুস্থ করছে না কেন? কারণ, আমরা কুর’আন নামের চিকিৎসাপত্রটা পড়ি, পড়ে ভাজ করে তাকে তুলে রাখি। কিন্তু চিকিৎসাপত্রে দেওয়া নির্দেশনাগুলো আমরা মানি না। কীভাবে মানব? আমরা তো পড়ে চলেছি সেইসব দুর্বোধ্য শব্দ যা আমাদের কিছু আদেশ করে না। নিষেধও না। পৃথিবীর সব ‘পড়া’ বলতে বোঝায় লিখিত শব্দের অর্থ বোঝা, ব্যতিক্রম কেবল আল-কুর’আন।
পৃথিবীর সব ‘শোনা’ বলতে বোঝায় একটি বার্তা কান পথে মগজে নেওয়া, ব্যতিক্রম কেবল আল-কুর’আন। ভাষার মূল কাজ যে ভাব আদান প্রদান, আল-ফুরকানের ক্ষেত্রে সে মূলনীতিটা মিথ্যে হয়ে গেছে। বোবার ইশারারও অর্থ আছে, অথচ কুর’আনুল কারীমের নেই? আল্লাহ আমাদের এ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন অথচ জানিয়ে দিলেন না আমাদের কি করতে হবে? অবশ্যই জানিয়েছেন। আমরা সেটাকে সম্মান দেখানোর নামে মাসজিদে কাঁচের আলমারিতে আটকে রেখেছি। যাদের অন্তরে কুর’আন মুখস্থ হিসেবে সংরক্ষিত আছে তাদের মস্তিষ্কেও কুর’আনের ভাব নেই, বার্তা নেই। কী দুঃখজনক! অথচ কুর’আন সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজে নিয়েছিলেন, আমাদের দিয়েছিলেন কুর’আন নিয়ে চিন্তা করার দায়িত্ব।

আমাদের অতি ব্যস্ত নগরজীবনে বাংলা-ইংরেজি শেখার পরে আসলে আরবি শেখার সময় মেলে সামান্যই। ৫০-৬০ বছরের জীবনের প্রস্তুতি নিতে নিতে ৩০ বছর বয়সেও নতুন ভাষা শিক্ষা করতে আমাদের আপত্তি হয় না। কিন্তু অনন্তকালের জন্য যে জীবন, সে জীবনের জন্য যে কুর’আন পড়ে বোঝা আবশ্যক সেই বোধের উদয় আমাদের জীবনে হয় না।
যারা ইসলামকে খুব ভালোবাসছেন তারাও অন্যের মুখে ডাইনোসরের গল্প শুনেই তৃপ্ত হয়ে কবরে চলে যাচ্ছেন। আল্লাহর শব্দরাজির যে অর্থ একটা মানুষ বুঝল সে হয়ত বাংলা বা ইংরেজিতে তা অনুবাদ করতে পারে, কিন্তু আসলে কী কুর’আনের অনুবাদ করা চলে? কুর’আন মুযিজা যে কারণে সেই ভাষাগত কারুশৈলীর ভাষান্তর কী চলে? মহান আল্লাহ আর মানুষে যে তফাত, আল্লাহর শব্দচয়ন আর অনুবাদকের শব্দচয়নেও তো একই তফাত। আকাশ-পাতাল তফাত। বেহিসাবি তফাত।

এতক্ষণ ধরে যে সমস্যাকাহন আমরা শুনলাম তার সমাধান কী? একেকজন একেক পদ্ধতিতে আগাচ্ছেন। কেউ ছোট বাচ্চাদের মত করে আরবি শেখার চেষ্টা করছেন, কেউ অনলাইনে ক্লাস করছেন, কেউ কেউ তো একেবারে মাদ্রাসাতেই ভর্তি হচ্ছেন। আমাদের এ সব ভাইদের ঐকান্তিক এসব প্রচেষ্টাকে আল্লাহ কবুল করে নিন। জীবনের সায়াহ্নে দাঁড়িয়েও যারা এসব প্রচেষ্টা নিচ্ছেন তার আদতে আরবি শিখে উঠতে না পারলেও অন্তত আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিঁচু করে বলতে পারবে, যখন থেকে বুঝেছিলাম তখন থেকে আরবি শেখার চেষ্টা করেছিলাম। কে জানে, হয়ত আল্লাহর কালাম বোঝার এই স্পৃহার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।
আল্লাহ যেন আমাদের রব্বের কথা শোনার এবং তার সাথে কথা বলার তাওফিক দেন। আমিন।

উৎসঃ ফেসবুক

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button