মেয়েদের জন্য মসজিদের দরজা খুলে দিন

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। একটা কাজে সস্ত্রীক লালমাটিয়াতে যেতে হয়েছিল। সেখানে থাকতেই মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেল। পাশেই, মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথে ছিল বড় একটা মসজিদ। ঢাকা শহরের ‘অভিজাত’ কিছু এলাকা বাদ দিলে বেশিরভাগ জায়গাতেই পর্যাপ্ত সংখ্যক মসজিদ আছে। ফলে, সুযোগ থাকলে প্রতি ওয়াক্তেই মসজিদে গিয়ে জামাতে নামায আদায় করা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত শহরে থাকার এটি একটি বড় সুবিধা।

কিন্তু, আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমি পড়লাম বিপদে। তারও তো নামায আদায় করা দরকার। এখন কোথায় যাই? তাকে পাশের বেসরকারি একটি হাসপাতালে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি চলে গেলাম মসজিদে। পরের ঘটনা ফিরে এসে তার কাছ থেকে শোনা। হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট নামাযের কথা শুনে চমকে উঠল, ইন্টারকমে ওদের কোনো বড়কর্তাকে ফোন দিলো কী করা যায় তা জানতে। বড়কর্তার সিদ্ধান্ত জানার আগেই হাসপাতালের এক আয়া আমার স্ত্রীকে ভেতরের এক ঘরে নিয়ে জায়নামায দিয়ে বলল, ‘একটু নামায পড়বে তার জন্য আবার ফোন করা লাগে!’

ঢাকা শহরে অনেক মসজিদ। বেশিরভাগ শপিং সেন্টার, হাসপাতাল এবং অফিসেও নামাযের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে। তার অধিকাংশই অবশ্য ছেলেদের জন্য। ভাবটা এমন যেন মেয়েদের ঘর থেকে বেরুতে হয় না, আর বেরুলেও নির্দিষ্ট সময়ে নামায আদায় করতে হয় না। মসজিদের এই শহরে মসজিদের দরজা মেয়েদের জন্য বন্ধ। ঘরের বাইরে নামায আদায়ের সুযোগ মেয়েদের জন্য রুদ্ধ। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ হিসেবে এটি কি আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা নয়?

***

Ibn Tulun Mosque

আজকের দিনের বাস্তবতা হলো, মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে বেরুতেই হচ্ছে। চিকিৎসার প্রয়োজনে হোক বা আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য হোক অথবা কোনো দরকারী কাজ সারার জন্য হোক, দূরপাল্লার ভ্রমণে হোক বা স্থানীয় পর্যায়ের যাতায়াতে হোক, নানাবিধ কারণে নানাবিধ পরিস্থিতিতে মহিলাদেরকে ঘরের বাইরে বেরুতে হচ্ছে। যাত্রাপথে বা এসব কাজের স্থানে ছেলেরা নামায আদায় করতে পারলেও ঘরের বাইরে নামায আদায় করার যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় মেয়েদের অনেকেরই নামায কাযা হয়ে যাচ্ছে।

***

ছেলেদের মতো মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায জামাতের সাথে আদায় করা মেয়েদের জন্য জরুরী নয়। প্রিয় নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “মহিলাদের নিজ কক্ষে নামায আদায় করা বাড়িতে নামায আদায় করার তুলনায় উত্তম, আর নির্জন ও অভ্যন্তরীণ স্থানে নামায আদায় করা ঘরে নামায আদায় করা থেকে উত্তম।” [আবু দাউদ, হাকিম] অতএব, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মেয়েদের জন্য ঘরে নামায আদায় করাই উত্তম।

তবে, এর মানে এই নয় যে নামায আদায় করার জন্য মেয়েরা মসজিদে যেতে পারবে না। প্রিয় নবী (ﷺ) থেকে এও বর্ণিত হয়েছে যে, “তোমরা আল্লাহর বান্দীদেরকে (অর্থাৎ, বিশ্বাসী মহিলাদেরকে) মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করতে নিষেধ করো না।” [মুসলিম, আবু দাউদ]

মহিলাদের জন্য মসজিদে নামায আদায় করা বিষয়ে প্রিয় নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত যাবতীয় বর্ণনাসমূহকে একত্রিত করলে আমরা এই উপসংহারে পৌঁছতে পারি যে, তাদেরকে মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করতে উৎসাহিত করা হয়নি, আবার মসজিদে যেতে নিষেধও করা হয়নি।

***

প্রিয় নবী (ﷺ)-এর সময়ে মহিলারা মসজিদে নামায আদায় করতে পারতেন। সেই মসজিদে কোনো পার্টিশনের ব্যবস্থা ছিল না। জামাতে নামায আদায় করার সময় পুরুষরা সামনে দাঁড়াতেন, তাঁদের পিছনে থাকতেন বাচ্চারা, আর তাঁদের পিছনে থাকতেন মহিলারা। কোনো কোনো সাহাবী মহিলাদের জন্য মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করাকে অপছন্দ করতেন বটে, কিন্তু তাই বলে তাঁরা মহিলাদের জন্য মসজিদের দরজা বন্ধও করে দেননি।

আমাদের দেশে মহিলাদের জন্য মসজিদের দরজা বন্ধ থাকার কারণে ঘরের বাইরে থাকা অবস্থায় যেসব মহিলার নামায কাযা হয়ে যাচ্ছে তাদের গুনাহের ভাগীদার কি আমরাও নই? তাদের নামায কাযা করতে বাধ্য করার জন্য আমরা পুরুষরাই তো দায়ী। তাই এমনও কি হতে পারে না যে, তাদের অপারগতার কারণে আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিলেন, কিন্তু তাদের জন্য মসজিদের দরজা বন্ধ রাখার মাধ্যমে নামায কাযা করতে বাধ্য করার ফলে তাদের পুরো গুনাহকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো? হতে কি পারে না?

অতএব, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ: দায়িত্বশীল আচরণ করুন, মেয়েদের জন্য মসজিদের দরজা খুলে দিন।

উৎসঃ আমার স্পন্দন

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button