ইবনে মিসকাওয়াহ : দার্শনিক ও ঐতিহাসিক
রচনায়: মুহাম্মদ নূরুল আমীন
দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ইবনে মিসকাওয়াহ আমাদের কাছে স্বল্প পরিচিত অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। ডেকার্তে, কান্ট-এর পরিচিতি আমাদের কাছে সুলভ হলেও ইবনে মিসকাওয়াহর মত একজন উচু দরের দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের খবর জানা আজ যেন অতি দুর্লভ কিছু। তিনি ও তার সাহিত্য প্রতিভা কারো কারো মতে ইবনে সীনার সাথে তুলনীয়।
বহুমুখী প্রতিভাধর ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব আবু আলী আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব মিসকাওয়াহ আর-রাযী ৯৩২ থেকে ৯৪২ খৃ. অব্দের মধ্যে রাযী নামক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান এবং পারিবারিক পরিচিতি নিয়ে ঐতিহাসিক ও জীবনীকারদের মধ্যে নানা ধরনের মত বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। ইবনে মিসকাওয়াহ আহমদ ইবনে কামিল (মৃত্যু, ৯৬১ খৃ) এবং আত-তাবারীর ছাত্র ছিলেন।
সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে তার পাঠ শুরু হয় যৌবনের প্রারম্ভেই এবং অনতিকালের মধ্যে তিনি প্রভূত প্রাজ্ঞ ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। যোগ্যতাবলে তিনি বুয়াহীয় উজীর ইবনুল আমীরের কর্মচারী নিযুক্ত হন। ইবনুল আমীরের বিশ্বখ্যাত লাইব্রেরীর দীর্ঘ সাতবছর ধরে তিনি প্রধান গ্রন্থাগারিক ছিলেন। খোরাসানের আক্রমণ কালে তিনি একবার এই লাইব্রেরীকে ধংসের হাত থেকে বাচান।
ইবনে মিসকাওয়াহ বহুদিন ধরে প্রভাবশালী রাজকর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেন এবং দায়লামী ও বুওয়াহীয় রাজদরবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি প্রায় একশত বছর জীবন পেয়েছিলেন এবং ১০৩০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী ইসপাহানে ইন্তিকাল করেন। ইসপাহানের ‘খাওয়াজু’ গ্রামে তার কবর রয়েছে বলে জানা যায়।
তিনি একজন ক্ষণজন্মা এবং শ্রেষ্ঠ আরব মনীষী ছিলেন। The Encyclopaedia of Islam (Vol- VII)এ লেখা হয়েছ “As both philosopher and historian, he is, in fact, one of the very rare intellectuals in the Arabic language who is known to have practised the two disciplines with competence and with a resolve to embark on the most complex ethico-political reflection.”
ইবনে মিসকাওয়াহ ইতিহাস, দর্শন, অংক, কবিতা প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার রচিত প্রায় ২০টি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়। তন্মন্ধে ‘তাজারীবুল উমাম ওয়া তাকুবুল হিমাম’ একটি ইতিহাস গ্রন্থ। এতে তিনি তার দেখা সমসাময়িক ইতিহাসও সন্নিবেশিত করেছেন। সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনাবলীর পুংখানুপুঙ্খ বর্ণনার চাইতে সাম্রাজ্যের উন্নতি ও অবনতি সম্পর্কে তিনি বেশী আলোকপাত করেন। গবেষণাধর্মী গ্রন্থটিতে হযরত নূহ (আ) হতে হিজরী ৩১৯ সাল পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জী বিবৃত হয়েছে।
মূল গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তুরস্কের আয়া সোফিয়াতে সংরক্ষিত আছে। তাজরীদুল উমাম গ্রন্থের বিশেষ বিশেষ অংশ ইউরোপে বেশ কয়েকবার অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। H.F Amedroz এবং D.S. Morgoliouth কর্তৃক ৭ খণ্ডে (১৯২০-২১) খৃষ্টাব্দে ইংরেজীতে অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়।
কিতাবু আদাবিল আরব ওয়াল ফুরস, তাহযীবুল আখলাক ওয়া তাতহীরুল আরাক, আল ফওজুল আসগর আল ফওজুল আকবর, তারতীকুল আদাত, কিতাবুস সীয়র, কিতাবুল মুসতাওফী প্রভৃতি তার রচিত গ্রন্থ। এর মধ্যে প্রথমোক্ত কয়েকটি গ্রন্থ বহুভাষায় অনূদিত হয়।
ইবনে মিসকাওয়াহ দর্শনে এরিস্টেটল প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে আল কিন্দির সমকক্ষ ছিলেন। আদাবুল আরাব ওয়াল ফুরস’ এবং তাজারিবুল উমাম’ গ্রন্থদ্বয়ে তিনি গভীর দৃষ্টি ও মুক্ত চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক আকর্ষণ ছিলো না। বরং ঘটনা সংঘটিত হওয়ার প্রকৃত কারণ ও ক্রটি-বিচূতির মূল্যায়নে তিনি বেশী প্রয়াসী ছিলেন। কোন ঘটনা কেন সংঘটিত হয়, ঘটনার এসব বিষয়ে তার জিজ্ঞাসা ও কার্যক্রম তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে। ইতিহাসকে তিনি অলৌকিক ঘটনাবলী ও পৌরাণিক কাহিনী হতে পৃথক রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নবুয়তের গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করেও ইতিহাসে এর সত্যিকারের গুরুত্ব নিরূপণ করতে পারেননি।
ইবনে মিসকাওয়াহর চিন্তাধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি কখনো ধর্ম ও শরীয়তের কথা ভুলে যাননি। এ কারণে তার মতবাদ ও চিন্তাধারা অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকদের তুলনায় শরীয়াতের সাথে অধিক সামঞ্জস্যের দাবী করতে পারে। নফস’ বা আত্মা সম্পর্কে আলোচনায় তিনি গ্ৰীক দর্শনের পরিবর্তে কুরআনকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি চারিত্রিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক শিক্ষার আলোচনা গ্ৰীক দার্শনিকদের চিন্তার ভিত্তিতে করা সত্ত্বেও তা ইসলামী শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক হয়নি।
তিনি মনে করতেন, অধিকাংশ লোক ভাল ও মন্দের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। শিক্ষার প্রভাবে তারা ভাল ও মন্দকে একসময় প্রাধান্য দেয়। কিন্তু মানুষের একক প্রচেষ্টায় সত্যকে অর্জন করা যায়না। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমেই সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। নির্জনতা, বৈরাগ্যবাদ ও জনবিচ্ছিন্নতাকে তিনি সমর্থন করতেন না।
‘আল ফওজুল আকবর’ গ্রন্থে তিনি আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ, একত্ববাদ ও নবুয়ত সম্পর্কে অতি শ্রমসাধ্য ও গবেষণাধর্মী আলোচনা করেন। নবুয়ত সম্পর্কে তিনি তার শিক্ষক আল ফারাবীর মতের বিরোধী ছিলেন। তিনি নবীকে দার্শনিকদের উপরে স্থান দেন।
ইবনে মিসকাওয়াহর সব রচনা পাওয়া যায় না। যেটুক পাওয়া যায় তাতে তার চিন্তার গাঢ়ত্ব ও মনীষার প্রতিফলন ঘটেছে। গদ্য ও পদ্য সাহিত্য চর্চায় তিনি উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তার মতো উন্নত চিন্তা সে যুগে বিরল ছিল। তিনি দর্শন ও চরিত্রের আলোচনায় সৌম্য সৌন্দর্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন।
সূত্র: মাসিক পৃথিবী পুরনো সংখ্যা
Alhamdulillah