সিয়ামের মুস্তাহাব আদবসমূহ
সকল প্রশংসা সে আল্লাহর জন্য, যিনি প্রত্যাশাকারীকে প্রত্যাশার ওপরে পৌঁছান এবং প্রার্থনাকারীকে প্রার্থনার বেশি দেন। আমি তাঁর গুণকীর্তন করি হেদায়াত দান ও তা অর্জনের জন্য। আর আমি প্রমাণ ও মূলনীতিসহ জেনে তাঁর তাওহীদের স্বীকৃতি দেই।
সালাত ও সালাম বর্ষণ হতে থাক যতদিন পুব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে বাতাসের প্রবাহ অব্যাহত থাকবে তাঁর বান্দা ও রাসূল আমাদের নবী মুহাম্মদের ওপর; তাঁর সাথী আবূ বকরের ওপর যিনি সফর ও স্থায়ী সর্বাবস্থায় ছিলেন তাঁর পাশে; উমরের ওপর যিনি এমন নির্ভীকতার সঙ্গে ইসলামের সাহায্য করেছেন যে কোনো খানাখন্দ বা পতনকে ভয় পাননি; উসমানের ওপর যিনি ছিলেন বিপদে অনঢ় ধৈর্যশীল; আলী ইবন আবী তালিবের ওপর যিনি আপন বীরত্ব দিয়ে শত্রুদের সন্ত্রস্ত করেছেন হামলার আগেই এবং তাঁর সকল পরিবার-পরিজন ও সাহাবীর ওপর যারা দীনের মূল ও শাখাগত বিষয়াদিতে প্রতিযোগিতায় অন্যদের হাত থেকে বিজয়টোপর ছিনিয়ে নিয়েছেন।
o প্রিয় ভাইয়েরা আমার! এ আসরটি সিয়ামের আদবের দ্বিতীয় প্রকার তথা মুস্তাহাব আদব প্রসঙ্গে। সিয়ামের মুস্তাহাব আদবসমূহের মধ্যে রয়েছে:
• সাহরী খাওয়া:
সাহরী বলা হয়, রাতের শেষাংশের খাওয়াকে। একে সাহরী বলার কারণ হচ্ছে এ খাবারটি ‘সাহর’ তথা রাতের শেষাংশে অনুষ্ঠিত হয়।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً»
‘তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে বরকত নিহিত রয়েছে।’
* সহীহ মুসলিমে ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ، أَكْلَةُ السَّحَرِ»
‘আমাদের ও আহলে কিতাবদের সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর দিয়ে সাহরী গ্রহণের প্রশংসা করে বলেছেন:
«نِعْمَ سَحُورُ الْمُؤْمِنِ التَّمْرُ»
‘মুমিনদের খেজুর দিয়ে সাহরী গ্রহণ কতই না উত্তম।’
* রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:
«السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلَا تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ»
‘সাহরী খাওয়া বরকতপূর্ণ। সুতরাং সাহরী পরিত্যাগ করো না, যদিও এক ঢোক পানি পান করে হয়। কারণ আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ সাহরী ভক্ষণকারীর ওপর সালাত পেশ করেন।’
* সাহরী ভক্ষণকারী ব্যক্তির উচিত, সাহরী খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ত করে যে, নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পালন এবং তাঁর নির্দেশের অনুসরণে তা গ্রহণ করছে; যাতে তার সাহরী হয় ইবাদত। তাছাড়া আরও নিয়ত করবে যে, সাহরী খাওয়ার মাধ্যমে সে সাওম পালনে সামর্থ্য হবে; যাতে করে এর দ্বারা সাওয়াব অর্জিত হয়।
* সুন্নাত হচ্ছে সুবহে সাদিক উদয়ের আগ পর্যন্ত বিলম্ব করে সাহরী খাওয়া। কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করতেন।
* কাতাদা রহ. আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَزَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ: «تَسَحَّرَا فَلَمَّا فَرَغَا مِنْ سَحُورِهِمَا، قَامَ نَبِيُّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الصَّلاَةِ، فَصَلَّى»، قُلْنَا لِأَنَسٍ: كَمْ كَانَ بَيْنَ فَرَاغِهِمَا مِنْ سَحُورِهِمَا وَدُخُولِهِمَا فِي الصَّلاَةِ؟ قَالَ: «قَدْرُ مَا يَقْرَأُ الرَّجُلُ خَمْسِينَ آيَةً»
‘আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যায়েদ ইবন সাবেত সাহরী গ্রহণ করলেন। যখন সাহরী গ্রহণ করা শেষ করার পর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সালাতের দিকে’ (চল)। তারপর তিনি সালাত আদায় করলেন। আমরা আনাসকে বললাম, তাঁদের সাহরী শেষ করা ও সালাতে প্রবেশ করার মধ্যে কত সময় ছিল? তিনি বললেন, ‘একজন লোক পঞ্চাশ আয়াত পড়ার মত সময়’।
* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাত থাকতেই আযান দিতেন; তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«كُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ، فَإِنَّهُ لاَ يُؤَذِّنُ حَتَّى يَطْلُعَ الفَجْرُ»
‘আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম আযান না দেয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার কর। কেননা সে সুবহে সাদিক উদয়ের পরই আযান দেয়।’
* বিলম্ব করে সাহরী খাওয়া সিয়াম পালনকারীর জন্য অধিক উপকারী ও ফজরের সালাত আদায় করার পূর্বে ঘুমিয়ে যাওয়া থেকে অধিক নিরাপদ। সাহরী খাওয়া ও সাওমের নিয়ত করার পরও দৃঢ়ভাবে সুবহে সাদিকের সময় প্রবেশ করা পর্যন্ত সাওম পালনকারীর জন্য পানাহার করার অধিকার রয়েছে।
* কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِ﴾ [البقرة: ١٨٧]
“আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাতের কালোরেখা থেকে ঊষার সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রকাশ না হয়”। [সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৭]
* আর সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হবে: সরাসরি আকাশের প্রান্তদেশ প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে অথবা নির্ভরযোগ্য সংবাদের মাধ্যমে যেমন আযান ইত্যাদি দ্বারা। অতঃপর যখন সুবহে সাদিক উদিত হবে তখনই (পানাহার ইত্যাদি থেকে) বিরত থাকবে, আর মনে মনে নিয়ত করবে, তবে কোনোভাবেই মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা যাবে না; কারণ নিয়ত উচ্চারণ করা বিদ‘আত।
• সিয়ামের মুস্তাহাব আদবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তাড়াতাড়ি ইফতার করা:
প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে সূর্যাস্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অথবা আযান বা অনুরূপ নির্ভরযোগ্য সংবাদের মাধ্যমে সূর্যাস্তের বিষয়ে প্রবল ধারণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করা।
* সাহ্ল ইবন সা‘দ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الفِطْرَ»
‘মানুষ যতক্ষণ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে কুদসীতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
«إِنَّ أَحَبَّ عِبَادِي إِلَيَّ أَعْجَلُهُمْ فِطْرًا».
‘তারা আমার সর্বাধিক প্রিয় বান্দা, যারা তাড়াতাড়ি ইফতার করে।’
* আর সুন্নাত হচ্ছে, কাঁচা খেজুর দ্বারা ইফতার করা। কাঁচা খেজুর না পাওয়া গেলে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করবে। আর যদি তাও না পাওয়া যায় তাহলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। কারণ, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন –
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُفْطِرُ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ عَلَى رُطَبَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ تمرَاتٌ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تُمرَاتٌ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ»
“নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিব নামায আদায়ের পূর্বে কিছু কাঁচা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকতো তাহলে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুর না থাকতো তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।”
যদি কোনো কাঁচা খেজুর, শুকনো খেজুর ও পানি না পাওয়া যায় তাহলে হালাল খাদ্য ও পানীয় যা সহজে মিলে তা দ্বারা-ই ইফতার করবে। যদি কোনো কিছুই না পাওয়া যায় তাহলে অন্তরে ইফতারের নিয়ত করবে।
তবে তার আঙ্গুল চুষবে না এবং মুখে লালা জমা করে গিলে ফেলবে না। যেমনটি কোনো কোনো সাধারণ লোকেরা করে থাকে!!
* ইফতারের সময় পছন্দনীয় দো‘আ করা উচিত:
* কেননা সুনান ইবন মাজায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন:
«إنَّ لِلصَّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ دَعْوَةٌ مَا تُرَدُّ»
‘নিশ্চয়ই ইফতারের সময় সিয়াম পালনকারীর একটি দো‘আ রয়েছে যা ফেরত দেওয়া হয় না।’
* অনুরূপ আবু দাউদ মু‘আয ইবন যাহরা থেকে মুরসাল সনদে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করার সময় এই দো‘আ পড়তেন:
«اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ، وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ»
‘হে আল্লাহ! আমি আপনারই জন্য সিয়াম পালন করলাম ও আপনার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করলাম।’
* আবু দাউদ অনুরূপভাবে ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করার সময় বলতেন:
«ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ»
‘পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সতেজ হলো এবং আল্লাহর ইচ্ছায় প্রতিদান প্রতিষ্ঠিত হলো।’
• সিয়ামের মুস্তাহাব আদবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির করা, দো‘আ করা, সালাত আদায় করা ও দান-সাদকা করা।
* হাদীসে এসেছে,
«ذَاكِرُ اللَّهِ فِي رَمَضَانَ مَغْفُورٌ لَهُ»
“রমযানে যে আল্লাহর যিকির করবে, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।”
* অনুরূপভাবে সহীহ ইবনে খুযাইমা ও ইবনে হিব্বান গ্রন্থে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ: الصَّائِمُ حَتَّى يُفْطِرَ، وَالإِمَامُ العَادِلُ، وَدَعْوَةُ المَظْلُومِ يَرْفَعُهَا اللَّهُ فَوْقَ الغَمَامِ وَيَفْتَحُ لَهَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ وَيَقُولُ الرَّبُّ: وَعِزَّتِي وَجَلَالِي لَأَنْصُرَنَّكِ وَلَوْ بَعْدَ حِينٍ»
“তিন ব্যক্তির দো‘আ ফেরত দেওয়া হয় না। (১) রোযাদার ব্যক্তি ইফতার করা পর্যন্ত, (২) ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা রাষ্ট্রপতি, (৩) মযলুম ব্যক্তির দো‘আ। তার দো‘আ আল্লাহ আকাশে মেঘমালার উপরে তুলে নেন এবং এর জন্য আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং মহান রব বলেন, আমার ইয্যত ও মাহাত্ম্যের কসম করে বলছি, অবশ্যই আমি তোমাকে সাহায্য করবো, কিছু সময় পর হলেও।”
* তাছাড়া বুখারী ও মুসলিমে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ القُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدُ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَةِ»
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মধ্যে বেশি দানশীল ছিলেন। আর রমযান মাসে তিনি আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন; যখন জিব্রাইল (‘আলাইহিস সালাম) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। জিব্রাইল রমযানের প্রতি রাতে তার সাথে সাক্ষাত করে পরস্পরে কুরআন পড়তেন, তখন তিনি প্রবাহিত বায়ুর চেয়েও অধিক হারে দান করতেন।’
* আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দান ছিল সার্বিক ও সবধরণের। যেমন আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করা ও আল্লাহর বান্দাদের পথপ্রদর্শনের জন্য জ্ঞান, জান ও মাল ব্যয় করা। অনুরূপভাবে আল্লাহর বান্দাদের কাছে সব রকমের কল্যাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য যত পথ ও পদ্ধতি রয়েছে সবই তিনি অবলম্বন করতেন, যেমন মূর্খদের জ্ঞানদান, তাদের অভাব-অভিযোগ পূরণ, তাদের মধ্যকার ক্ষুধার্তদের আহার প্রদান। আর তাঁর দান রমযানে বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, সময়ের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতনতা, সওয়াবের পরিমানে বর্ধিত হওয়া। তাছাড়া ইবাদতকারীদের ইবাদতে সহযোগিতা করাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এভাবে তিনি সাওম ও খাবার খাওয়ানো এ দু’টি কাজকে একসাথে করতেন, এ দুটো কাজই জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম।
* অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমে আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ
«مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ، إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ»
“তোমাদের মধ্যে কে আজ সাওম অবস্থায় প্রত্যুষে উপনীত হয়েছ? আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি। রাসূল বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ জানাযার সালাতে শরীক হয়ে জানাযার পিছু নিয়েছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তরে বললেন, আমি। রাসূল বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ একজন মিসকীনকে খাইয়েছ? আবু বকর বললেন, আমি। রাসূল বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ একজন রোগীর সেবা করেছ? আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। তখন রাসূলুল্লাহ্ ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তির মধ্যে এসব গুণ গুলো মিলিত হয়েছে সে অবশ্য-ই জান্নাতে যাবে।”
• সিয়ামের মুস্তাহাব আদবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের কথা অন্তরে সদা জাগরুক রাখা।
সিয়ামের মুস্তাহাব আদবসমূহের অন্যতম হলো, সিয়াম পালনকারী সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কথা সর্বদা স্মরণ করবে; যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাকে সিয়াম পালনের তাওফীক দিয়েছেন, তার জন্য সহজ করে দিয়েছেন, ফলে সে এ দিনের সিয়াম পূর্ণ করতে পেরেছে, এ মাসের সিয়াম পুরোপুরিভাবে আদয় করতে পেরেছে। কারণ, এমন অনেক লোক রয়েছে যারা সিয়াম পালনের নে‘আমত থেকে মাহরূম হয়েছে, তাদের কেউ কেউ প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পূর্বে মারা গেছে, আবার কেউ ছিল সিয়াম পালনে অক্ষম, আবার তাদের কেউ পথভ্রষ্টতা ও দ্বীন বিমুখিতার ফলে সিয়াম পালন করতে পারেনি।
তাই সিয়াম পালনকারীর উচিত হলো এ নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করা; যা গোনাহের ক্ষমা, মন্দ-পাপাচার থেকে মুক্তি, স্থায়ী নে‘আমতপূর্ণ দারুন না‘ঈম জান্নাতে মহান সম্মানিত রবের পাশে থাকার মত সুউচ্চ মর্যাদা লাভের মাধ্যম।
o ভাইয়েরা আমার! সিয়ামের আদবগুলো রক্ষা করুন। আর (আল্লাহর) গযব (ক্রোধ) ও শাস্তির কারণগুলো থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখুন। সালাফে সালেহীন তথা সৎকর্মশীল পূর্বসুরীদের গুণে গুণান্বিত হোন, কেননা পূর্ববর্তীরা যেভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে এবং পাপাচার থেকে বিরত থেকে সংশোধিত হয়েছিলেন, শেষ যামানার উম্মতদেরও সে একই পদ্ধতিতে সংশোধিত হতে হবে।
* ইবন রজব রহ. বলেন, সিয়াম পালনকারীরা দুস্তরে বিভক্ত:
প্রথম স্তর: ওই সকল লোক, যারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য স্বীয় পানাহার ও কামপ্রবৃত্তি ত্যাগ করে এবং জান্নাতে তার বিনিময় আশা করে। তিনি তো আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে ব্যবসা করেছেন ও লেন-দেন করেছেন। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান কখনও নষ্ট করেন না, যে তাঁর সাথে লেনদেন করবে সে কখনও আশাহত হবে না বরং সবচেয়ে বড় ধরনের লাভে ধন্য হবে।
* একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোককে উদ্দেশ করে বললেন:
«إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءً لِلَّهِ، إِلَّا آتَاكَ اللَّهُ خَيْرًا مِنْهُ»
‘নিশ্চয় তুমি যা কিছুই আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের কারণে পরিত্যাগ করবে, তার চেয়েও উত্তম বস্তু তিনি তোমাকে প্রদান করবেন।’
এ ধরনের সিয়াম পালনকারীর চাহিদা মত আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে তাকে শ্রেষ্ঠতম খাদ্য-পানীয় ও স্ত্রী দান করবেন।
* আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
﴿كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ هَنِيَٓٔۢا بِمَآ أَسۡلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡأَيَّامِ ٱلۡخَالِيَةِ ٢٤ ﴾ [الحاقة: ٢٤]
‘(বলা হবে) ‘বিগত দিনসমূহে তোমরা যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান কর।’ {সূরা আল-হাক্কাহ্, আয়াত: ২৪}
* মুজাহিদ রহ. সহ আরো অনেকে বলেন, এ আয়াত সিয়াম পালনকারীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।
* আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখেছেন:
« وَرَأَيْتُ رَجُلًا مِنْ أُمَّتِي يَلْهَثُ عَطَشًا كُلَّمَا دَنَا مِن حَوْضٍ مُنِعَ وطُرِدَ، فَجَاءَهُ صِيَامُ رَمَضَانَ فَسَقَاهُ وَأَرْوَاهُ»
‘আর আমি আমার উম্মতের এক লোককে দেখতে পেলাম সে পিপাসায় জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। যখন সে পানি পানের জন্য হাউজের কাছে যায়, তখন তাকে সেখানে বাধা দেয়া হয় এবং সে ওখান থেকে বিতাড়িত হয়। অতঃপর তার কাছে রমযানের সিয়াম এসে উপস্থিত হলো এবং তাকে পানি পান করিয়ে তৃপ্ত করালো।’
o হে আমার জাতি! এ রমযানে আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে (কুরআন তিলাওয়াত ও নফল সালাতের মাধ্যমে) কথা বলার কি কেউ নেই?
তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য জান্নাতে সংরক্ষিত নেয়ামতরাজির প্রতি আগ্রহী কি কেউ নেই?
কবির ভাষায় বলতে হয়:
مَنْ يُرِدْ مُلْكَ الْجِنَانِ فلْيَدعْ عنه التواني
ولْيَقْم في ظُلمةِ اللي لِ إلى نورِ القُرآنِ
ولْيَصِلْ صوماًبصومٍ إن هذا العَيشَ فَانِ
إنَّما العيشُ جِوارُ الله في دارِ الأمانِ
যে হতে চায় জান্নাতের মালিক সে যেন ছাড়ে অবহেলা
সে যেন দাঁড়ায় রাতের আঁধারে কুরআনের আলো নিয়ে
সে যেন পর্যায়ক্রমে পালন করে সিয়াম নিশ্চয় এ জীবন নশ্বর
প্রকৃত জীবন হলো আল্লাহর প্রতিবেশীত্বে জান্নাতের বাড়ীতে।
সিয়াম পালনকারীদের দ্বিতীয় স্তর: এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত পার্থিব সব কিছু ছেড়ে বিরত থাকার সাওম পালন করে। তারা মস্তিষ্ককে মন্দ চিন্তা থেকে এবং উদরকে পূর্ণ খাবার মুক্ত রাখে। মৃত্যু ও মৃত্যুর পর পঁচে-গলে যাবার কথা স্মরণ করে এবং আখিরাতের উদ্দেশে দুনিয়ার সৌন্দর্য ত্যাগ করে। এমন লোকের জন্যই তো তার রবের সাথে সাক্ষাত ও তাঁর দর্শন লাভ হবে প্রকৃত ‘ঈদুল ফিতর’।
কবি বলেন,
‘বিশেষ (প্রকৃত) সিয়াম পালনকারীদের সিয়াম হলো, জিহ্বাকে মিথ্যা বলা ও অপবাদ দেয়া থেকে বিরত রাখা।
আল্লাহর সাধক ও সান্নিধ্যে ধন্য ব্যক্তিদের সিয়াম হলো, অন্তরকে অন্য কারো অনুপ্রবেশ ও তাঁর পর্দা থেকে হেফাযত করা।
o আল্লাহর পরিচয় প্রাপ্তগণকে পার্থিব জগতের সুরম্য অট্টালিকা স্বীয় রবের দর্শনের বিপরীতে প্রশান্তি দিতে পারে না। তাঁর দর্শন ছাড়া কোনো ঝর্ণাধারা তাদের পরিতৃপ্ত করতে পারে না। তাদের চিন্তা-চেতনা চাওয়া-পাওয়া এগুলো থেকে অনেক মহৎ।
o যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ পালনার্থে আজ দুনিয়াতে প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রাখার সাওম পালন করবে, আগামীকাল জান্নাতে সে ঐসব চাহিদা লাভ করবে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অপর সব কিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখার সাওম পালন করবে, তার ঈদ বা খুশী তো সেদিন হবে যে দিন সে আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করবে।
﴿مَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ ٱللَّهِ فَإِنَّ أَجَلَ ٱللَّهِ لَأٓتٖۚ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٥ ﴾ [العنكبوت: ٥]
‘যে আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয় আল্লাহর নির্ধারিত কাল আসবে। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৫}
o তাই হে তাওবাকারীগণ! আজ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে সিয়াম পালন করুন, তাহলে প্রতিপালকের সাক্ষাতের দিন ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।
হে আল্লাহ! আপনার প্রতি নিষ্ঠা সৃষ্টি করে আমাদের অন্তরলোককে সৌন্দর্যমণ্ডিত করুন এবং আমাদের আমলগুলোকে আপনার রাসূলের আনুগত্য আর তাঁর আদব অনুকরণের মাধ্যমে সুষমামণ্ডিত করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের আলস্যের নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিন, অধঃপতন থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের অপরাধ ও পাপরাশি ক্ষমা করুন। হে শ্রেষ্ঠ দয়াময়! আপনার দয়ায় আমাদেরকে, আমাদের পিতামাতা ও জীবিত-মৃত সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন। আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।