উপমহাদেশে ইসলামের আগমন

রচনায়: ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলার সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সুদূর অতীতকালে। মরুময় আরববাসী জীবনধারণের জন্য খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আবহমানকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। আবিসিনিয়া হতে সুদূর চীন পর্যন্ত  তাদের ব্যবসা- বাণিজ্য বিস্তৃত ছিল। তারা জলপথ ও স্থলপথ উভয় পথেই ব্যবসা পরিচালনা  করতো। উটের সাহায্যে স্থলপথে এবং নৌযানের সাহায্যে জলপথে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে একদেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করতো। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব থেকে আরবরা এ উপমহাদেশে যাত্রা করে আসছে। হযরত ইউসূফের (আ.) আমল থেকেই এ উপমহাদেশের  সাথে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালু ছিল। হযরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক হাজার বছর পূর্ব থেকে দণি আরবের সাবা সম্প্রদায়ের লোকেরা এ উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব এলাকায় পালতোলা জাহাজে করে যাতায়াত করতো। আবর থেকে চীনের মাঝ পথে তাদের কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। প্রথম ঘাঁটি ছিল মালাবার। মালাবার উপকূল হয়ে আবরগণ চীনের পথে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতো।

আরব বণিকগণ বাংলার দণিাঞ্চলীয় বন্দরগুলোতে এসে চন্দনকাঠ, হাতীর দাঁত, মসলা এবং সূতী কাপড় ক্রয় করতো এবং জাহাজ বোঝাই করে নিজ দেশে নিয়ে যেতো। আরবদের সামুদ্রিক বাণিজ্য প্রসার হওয়ার সাথে সাথে এ উপমহাদেশের উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর আশে পাশে আরবদের স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। দণি ভারতের মালাবার, কালিকট, চেরর  এবং চট্টগ্রাম ও আরাকান উপকূলে আরব জনগণের এরূপ বসতি কয়েক শতাব্দী পূর্বেই গড়ে উঠেছিল। আরবদেশ থেকে বছরে কমপে দু’বার এসব উপনিবেশ নৌবহর নোঙর করতো। ফলে ইসলামের আগমণের সাথে সাথেই তা এদেশের জনগণের কাছে পৌছেছিল। কারণ ইসলামের আবির্ভাব তখন সমগ্র আরবে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরূপ সাড়া জাগানো খবর বণিকদের মাধ্যমে এ উপমহাদেশে পৌঁছেনি এমনটি ধারণা করা অসঙ্গত বলে মনে হয়। এসময় রাসূলের (সা.) আবির্ভাব এবং তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলামের কথা লোকমুখে এক চমকপ্রদ খবর হিসেবে প্রচারিত হতো বলে অনুমেয় হয়। এর প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে একদিন গুজরাটের রাজা ভোজ তাঁর ইমারতের ছাদে ওঠেন এবং চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত দেখতে পান। এ রহস্য উদঘাটনের জন্য তিনি ব্রাহ্মণদের ডেকে পাঠান। তারা যোগ সাধানা করে বললেন-আরবদেশে এক মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর ধর্মের সত্যতা প্রমাণের জন্য আঙ্গুলের ইশারায় এ অলৌকিক ঘটনা দেখিয়েছেন। রাজা হযরত মুহাম্মদের (সা.) কাছে  দূত পাঠালেন ও সাথে একখানি পত্র দিলেন। তাতে লিখেন, হে মহামান্য! আপনার এমন একজন প্রতিনিধি আমাদের দেশে পাঠান, যিনি আমাদের আপনার সত্য ধর্ম শিা দিতে পারেন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর জনৈক সাহাবীকে হিন্দে পাঠিয়ে দেন। তিনি রাজা ভোজকে ইসলামের বায়’য়াত করান। তাঁর নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ। রাজার ধর্ম পরিবর্তনে প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। তারা রাজার পরিবর্তে রাজার ভাইকে সিংহাসনে বসায়। যে সাহাবী এসেছিলেন তিনি এদেশেই ইন্তিকাল করেন। তাঁর ও ‘আব্দুল্লাহর (রাজা ভোজ) মাজার গুজরাটের দারদা শহরেই রয়েছে।

অপর এক বর্ণনায় রতন আল-হিন্দ নামে এক লোক মহানবীর (সা) সমীপে গিয়ে সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বলে জানা যায়। আরবে রাসূলুল্লাহর (সা.) ইসলাম প্রচারের কথা জানতে পেরে স্মরণদ্বীপের বাসিন্দারা রাসূলের (সা.) কাছে দূত পাঠান। এ দূত মদীনায় পৌঁছে হযরত ‘উমরের (রা.) খিলাফত কালে। হযরত ‘উমরের (রা.) সাথে তার সাাৎ হয়। তিনি কিছু কাল সেখানে অবস্থন করেন।  তিনি ইসলাম ও ইসলামের নবী ও সাহাবীদের সম্পর্কে প্রত্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। দেশের ফেরার পথে ঐ দূত বেলুচিস্তানের কাছে মাকরান এলাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার সাথী স্মরণদ্বীপের কাছে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। এতে স্মরণদ্বীপের জনগণের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। স্মরণদ্বীপের রাজাও এ সময় ইসলাম গ্রহণ করেন বলে জানা যায়।

রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবদ্দশায় তাঁর কয়েকজন সাহাবী ভারতের মালাবার উপকূলে আগমন করেন। সেখানে তাঁরা চেরুমল ও পেরুমল নামক হিন্দু রাজার সাাৎ করেন। এ রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন। রাজা শরীফ ইব্ন মালিক নামক একজন আরবীয় মুসলিমকে ভূমি প্রদান করেন ও ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। আরবীয় বণিকগণ সমগ্র মালাবার উপকূলে ও দাণিাত্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। মালাবারের ইসলাম প্রচারকারী মুহাজিরগণ মোপলা নামে পরিচিত।

ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, চেরর রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন ত্যাগ করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করার অভিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করে রাসূলের (সা.) সান্নিধ্যে হাজির হন। তাঁর নিকট ইসলামের বায়‘আত গ্রহণ করেন। মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময রাজা আল্লাহর নবীর জন্য আদা ও এদেশে তৈরি একটি তরবারীসহ কিছু মূল্যবান উপহার সামগ্রী সঙ্গে করে নেন। নবী করীম (সা.) সেই  আদা নিজে খান এবং সাহাবীদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। সেই সময় থেকেই স্থানীয় মুসলিম ও অমুসলিমগণ এ ধারণা পোষণ করতো যে, রাজা কিছুকাল রাসূলের (সা.) সান্নিধ্যে অবস্থান করেন। পরে দেশে ফেরার পথে শহর নামক স্থানে ইন্তিকাল করেন।

মহানবী (সা.) কর্তক (৬১০ খ্রী.) আরব ভূমিতে ইসলাম প্রচারের এক শতাব্দীকালের মধ্যে মুসলিমদের আধিপত্য আটলান্টিক মহাসাগর  হতে ভারত সীমান্ত এবং কাস্পিয়ান সাগর হতে উত্তর আফ্রিকা (মিসর) পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। এতে সহজেই অনুমান করা যায়, পরবর্তীতে আরবের সাথে অপরার অঞ্চলের মত ভারতের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। আরব নাবিক ও বণিকগণ সর্বদা মালাবার দিয়ে বঙ্গ প্রদেশ ও কামরূপ হয়ে চীন দেশে যাতায়াত করতেন। এ মালাবারই ছিল তাদের মধ্য পথের প্রধান বন্দর। এখানকার মুহাজিরগণের ভাষাও ছিল আরবী। সুতরাং হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলাম ধর্মের সকল প্রকার বিবরণ সম্পর্কে তারা যথাসময়ে সম্যকরূপে অবগত হতে পেরেছিলেন, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। এ প্রসঙ্গে এটিও স্মরণযোগ্য যে, আরব বণিকরাই ছিল হিজরী সপ্তম শতক পর্যন্ত  এশিয়া ও আফ্রিকায় ইসলাম প্রচারের প্রধান উদ্যোগী। উক্ত বর্ণনার আলোকে বলা যায় যে, এ উৎসাহী ও ধর্মপ্রাণ প্রচারকগণের সংশ্রবে আসার ফলেই আমবারের আরব মুহাজিরগণ রাসূলের (সা.) জীবনকাল খুব সম্ভবত হিজরী সনের প্রথমদিকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সূচনা পর্বে বাংলায় ইসলামের আগমন এবং ইসলামী দা’ওয়াহ্কে দুটি পর্যায় বা মাধ্যম এ ভাগ করা যেতে পারে:

এক. ইসলাম প্রচারক সাহাবীগণের আগমন ও তাদের দা’ওয়াত প্রদান।

দুই. আরব বণিকদের আগমন ও দা’ওয়াত দান।

এক. ইসলাম প্রচারক সাহাবীগণের আগমন ও তাঁদের দা’ওয়াত প্রদান

হিজরী দশ সাল ৯ই যিলহজ্জ মাস। রাসূল (সা.) আরাফার ময়দানে প্রায় দুই লাখ সাহাবীর বিশাল জনসমাবেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। নবীজির এই ভাষণ ছিল সর্বজনীন এক অনবদ্য ভাষণ। এই ভাষণের গতিধারা থেকে এটিই প্রতীয়মান হচ্ছিল, ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। ঠিক এ সময়ই আল-কুরআনের একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়। যার অর্থ হলো, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়া’মতকে সম্পূর্ণ করলাম।”

তিনি তাঁর এ বিদায়ী ভাষণে সাম্যবাদের এক মহান জয়োগান ব্যক্ত করলেন। তিনি বলেছিলেন, “হে মানব জাতি! তোমাদের প্রভু এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের পিতা একজন। তোমরা জেনে রেখ আরবের উপর কোন অনারবের, কোন অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোন মর্যাদা নেই। কেবলমাত্র আল্লাহভীতিই মর্যাদার মানদণ্ড। আজকের এই পবিত্র দিনে, পবিত্র মুহূর্তে তোমাদের সামনে মানবতার যে দিক নির্দেশনা পেশ করলাম তা তোমরা যারা উপস্থিত আছো, অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দিবে।

আজ থেকে মহাপ্রলয় পর্যন্ত ইসলাম মানবজাতির জন্য এক সর্বজনীন জীবন বিধান হিসেবে পরিগণিত হলো। বিদায় হজ্জে রাসূল (সা)-এর এ ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মরণজয়ী সাহাবীগণ গোলার্ধের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের সুমহান বাণী পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াই ছিল তাদের মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সমগ্র বিশ্বে সাহাবীগণের ছড়িয়ে পড়ার ধারাবাহিকতায় ভারতীয় উপমহাদেশেও তাদের আগমন ঘটেছিল। উল্লেখ্য যে, পূর্বকাল থেকেই ভারতের সাথে আরবদের বিভিন্ন েেত্র যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর সময় থেকে আরব-বাংলার যোগাযোগ সূচিত হয়। আরবরা নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগমন করত। যোগাযোগ ও পূর্ব সম্পর্কের কারণে রাসূল (সা.) ভারতীয় এলাকা থেকে অনেক সুগন্ধি উপহার হিসেবে লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। এমনকি জনৈক ভারতীয় রাজা রাসূল (সা.)কে কিছু আচার উপহার দিয়েছিলেন। ইমাম বুখারী বর্ণনা করেন যে, একবার হযরত আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর চিকিৎসার জন্য ভারতীয় চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এ জন্য ‘হিন্দ’ শব্দটির অস্তিত্ব হাদীসে বিদ্যমান। রাসূল (সা.) বিভিন্ন সময়ে ‘হিন্দ’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর ওফাতের পূর্বে তিনি কোন এক সময়ে হিন্দুস্থানী শব্দ ব্যবহার করেছেন। কথিত আছে যে, হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ কোন একটি প্রতিনিধি দলসহ রাসূলের (সা.) নিকট উপস্থিত হলে তিনি উপস্থিত লোকদেরকে শনাক্ত করার জন্য বলেছিলেন, আমার মনে হয় এরা হিন্দুস্থানী লোক। এতে প্রতীয়মান হয় যে, হিন্দুস্থান সম্পর্কে রাসূলের (সা.) ধারণা ছিল।

ইসলামে তিনটি যুগকে শ্রেষ্ঠ যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসূল (সা.) এ তিনটি যুগ সম্পর্কে বলেছেন, আমার যুগ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ, অতঃপর পরবর্তী যুগ, এরপর তৎপরবর্তী যুগ। রাসূলের এ বাণীতে তিনটি শ্রেষ্ঠ যুগের কথা বলা হয়েছে। এক. রাসুলের যুগ, দুই. সাহাবী ও তাবিঈদের যুগ, তিন. তাবে-তাবিঈদের যুগ। সৌভাগ্যক্রমে এ যুগগুলোতেই বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে। রাসূলের (সা.) মাক্কী জীবনে মক্কায় ইসলাম প্রচারিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই প্রাচীন বাংলায় সাহাবীগণের আগমন ঘটেছিল বলে অনুমান করা হয়। এ দেশে ইসলামের আগমনের প্রতি রাসূলের (সা.) উৎসাহ কাজ করে। হাদীস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাসুল (সা.) আরবের পূর্ব দিগন্তে সুদূর চীন পর্যন্ত ইসলামের বাণী পৌঁছানোর জন্য ইচ্ছা পোষণ করতেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার পত্র প্রেরণের ঘটনা এ দাবির যৌক্তিকতা বহন করে।

কখন বাংলায় সাহাবীগণের আগমণ বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছিল তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা বড় কঠিন। তবে এতদসম্পর্কে ঐতিহাসিকগণের পরিবেশিত তথ্যাদি বিশেষণ করল দেখা যায় যে, হিজরী প্রথম শতকেই ভারতীয় উপমহাদেশে তথা মালাবারে ইসলামের আগমন ঘটে। তবে বাংলাদেশের উপকুলবর্তী এলাকা চট্টগ্রামে কখন ইসলামের আগমন ঘটেছিল তা সুনিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা খুবই দুরূহ হলেও খৃষ্টীয় অষ্টম অথবা নবম শতকে চট্টগ্রামের সাথে আরবের মুসলমান বণিকদের যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ড. আব্দুল করিমের উক্তি উলেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন যে, “খ্রিষ্টীয় অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরবীয় মুসলমান বণিকদের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে আরব ব্যবসায়ীদের আনা-গোনার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব বণিকরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্য গঠন না করলেও আরবদের যোগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে “না” সূচক শব্দ ব্যবহারও আরবী  ভাষার প্রভাবের ফল। অনেক চট্টগামী পরিবার আরব বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। চট্টগ্রামী লোকের মুখায়ব আরবদের অনুরূপ বলেও অনেকে মনে করেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা যেমন, আলকরণ, সুলুকুবহর, বাকালিয়া ইত্যাদি এখনও আরবী নাম বহন করে।” ড. করিমের এই বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, চট্টগ্রাম দিয়েই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে। রিসালাতের যুগে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে যে সমস্ত সাহাবী আগমন করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, হযরত আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াহাব (রা.), তামীম আল আনসারী (রা.), কায়স ইবনে সায়রাফী (রা.), উরওযা ইবন আছাছা (রা.) ও আবু কায়স ইবন হারিছাহ (রা.) প্রমুখ।

হিজরী তৃতীয় শতকের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আবাদান আল মারওয়াযীর বর্ণনা মতে, হযরত আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবন ওয়াহাব ছিলেন রাসূলের মামা, তিনি নবুয়্যতের পঞ্চম বছরে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন এবং নবুয়তের সপ্তম বছরে তিনজন সাহাবী ও কয়েকজন হাবশী মুসলমান সহ তৎকালীন আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর উপহার হিসেবে দেয়া একটি জাহাজে চীন অভিমুখে যাত্রা করেন। ৬১৭ খ্রীষ্টাব্দে রাসুলের হিজরতের ৬ বছর পূর্বে তারা আবিসিনিয়া থেকে রওনা হন এবং ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে হিজরী তৃতীয় সালে চীন দেশে উপনীত হন। আবিসিনিয়া থেকে চীনে পৌঁছার অন্তবর্তীকালীন ৯ বছর সময় তারা বিভিন্ন স্থানে যাত্রা বিরতি করেন এবং ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা বাংলাদেশের জাতগাম সমুদ্র বন্দরে অবস্থান করে ইসলাম প্রচার করেছিলেন বলে জানা যায়। উল্লেখ্য যে, জাতগাম চট্টগ্রামের পুরাতন নাম। এ বন্দরটি বহুকাল পূর্ব থেকে আরবদের কাছে পরিচিত ছিল। এ পথ দিয়েই তারা তিব্বত ও চীনে যাতায়াত করত। সাহাবী আবু ওয়াক্কাসের এই সমুদ্র ভ্রমণের বিবরণ দিতে গিয়ে বাশার মঈনুদ্দীন তার সাগর বিজয় ও আমেরিকা আবিষ্কারে মুসলমান গ্রন্থে লিখেছেন যে, “ইসলামের সুবহে-সাদিকের আলোকরশ্মি যখন মরু আরবের সমগ্র আকাশে পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি সেই আলোক আঁধারীর কুহেলী মুহূর্তেও মুসলমানরা সাগর মরু আর পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে দিগন্তের পানে ছুটেছিল। সূর্যের আগে যেমন তার রশ্মি ছোটে, তেমনি দিক থেকে দিগন্তের পানে ছুটেছিল তারা। আর তাইতো দেখি পৃথিবীর আর এক প্রান্তে বিশ্বনবীর সাহাবী ও মাতুল ওয়াহাব (রা.) চীনের ক্যান্টন বন্দরে কর্মকান্ত দেহে শান্তির শয্যা গ্রহণ করেছেন। সাহাবী হযরত ওয়াক্কাস (রা.) ঠিক একই সময়ে মাহমুদ বন্দরে এবং সাহাবী তামীম আনসারী (রা.) মাদ্রাজের ১২ মাইল দক্ষিণে মেলাপুরে চিরনিদ্রায় নিরবচ্ছিন্ন অবসর গ্রহণ করেছেন। ঐসব অঞ্চলে তাঁদের মাজার আজও বিদ্যমান। কাজেই এটা সহজেই অনুমেয় যে, আবিসিনিয়ায় ইসলাম প্রচার করেই মুসলমানরা সেখানে তাদের গতিরুদ্ধ বা সীমায়িত করেনি। আবিসিনিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে তারা পৌঁছেছিল। এবং এভাবেই তারা ভারত মহাসাগরের উত্তর উপকূল ও দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন।”

বাশার মঈনুদ্দিনের উপরোক্ত বর্ণনা থেকে রাসূলের মাক্কী জীবনেই পৃথিবীর পূর্ব দিগন্তে সাহাবীগণের আগমন নিশ্চিত বলে প্রমাণিত হয়। ঐতিহাসিকদের পরিবেশিত তথ্য থেকে আরো জানা যায় যে, প্রাচীন কালে চীনের ক্যান্টন বন্দরে যাবার পথে বঙ্গোপসাগরে উপকূলবর্তী এলাকায় আরবদের একটি যাত্রাবিরতি কেন্দ্র ছিল। এটিকে কেউ কেউ চিটাগাং, সিলেট ও ক্রিদিং নামে উল্লেখ  করেছেন। সম্ভবত সাহাবী আবু ওয়াক্কাস ও তার সঙ্গীগণ এই বন্দরে যাত্রাবিরতি করে এতদঞ্চলে ইসলাম প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের পথিকৃৎ সাহাবী। তার পদাংক অনুসরণ করে উত্তরকালে আরো অনেক আরব মুসলমান ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে আগমন করে স্থায়ী নিবাস স্থাপন করেছিলেন। চট্টগ্রামের বঙ্গোপসাগরে উপকূলবর্তী এলাকায় তাদের ছিল নিবাস ।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. আব্দুল করিমের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম এলাকায় আরবরা যে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিলেন এবং বাঙালি মেয়েদের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন তা এ অঞ্চলের কিছু কিছু লোকের চেহারা থেকে অনুমান করা যায়। দৈহিক গঠন, সৌষ্ঠব, রং, চেহারা প্রায়ই তাদের সাথে মিলে যায়। এছাড়া এ অঞ্চলে অনেক আরবী ভাষা বাংলা ভাষার সঙ্গে একীভূত হয়ে এখানে আরব মুসলমানদের অবস্থানকে সুনিশ্চিত করে।

দুই. আরব বণিকদের আগমন ও দা’ওয়াত দান

আরব বণিকদের মাধ্যমে অনারব অঞ্চলে ইসলামের আগমন এবং ইসলাম প্রচার  ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ  অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে । পূর্বকাল থেকেই আরবরা ছিল ব্যবসা বাণিজ্যে পারদর্শী। আর এই ব্যবসা বাণিজ্যের সুবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় অতি অল্প সময়ে ইসলামের এই সুমহান বাণী অর্ধগোলার্ধে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একেকজন বণিক ইসলাম প্রচার ও প্রসারে এক একজন ধর্মপ্রচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলশ্র“তিতে প্রথম যুগেই ইসলামের সত্যবাণী পশ্চিমে মরক্কো, স্পেন, পর্তুগাল থেকে সুদুর চীন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে মুসলিম বিজেতাগণের মাধ্যমে  ইসলামের আলো পৌঁছলেও এ দুনিয়ায় এমন কয়েকটি দেশ আছে যেখানে কোনদিন মুসলিম বিজেতার আগমন ঘটেনি। অথচ সেখানে ইসলামের সত্যবাণী পৌঁছেছে । এর কারণ হল, ইসলাম প্রচারকদের একমাত্র নিঃস্বার্থ সত্য প্রচারের আকাক্সা এবং নিষ্কলুষ চরিত্র মাধুর্যই সে সব অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং একে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ পর্যায়ে পূর্ব ও দনি ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, জাভা সুমাত্রা, বোর্ণিও তথা সমগ্র ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বণিকরূপে আরব ধর্মপ্রচারকদের নিরলস প্রচেষ্টায় ইসলামের সুমহান বাণী বিকশিত হয়েছে এসব অঞ্চলে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে তাদের মাধ্যমে ইসলামের বাণী বিস্তৃতি লাভ করে।

বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ও প্রচারের দ্বিতীয় মাধ্যম হলো আরব বণিকরা। এদেশে আরব বণিকদের আগমনের পূর্বে আরব-বাংলা সম্পর্ক আলোচনা করা অনস্বীকার্য। কখন আরবদের সাথে বাংলার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এ সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকগণের বিরাট এক অংশ মনে করেন যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর পূর্বে বাংলার সাথে আরবদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রাচীন ইউনানী উৎসসমূহে এর প্রমাণ বিদ্যমান। যেমন ংবযড়ভভ ঔ..ি রচিত ঢ়ধৎরঢ়ষঁং ড়ভ ঃযব ঊৎুঃযৎধবধহ ংবধ গ্রন্থে পরিবেশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, যীশু খ্রীষ্ট্রের জন্মের পূর্ব থেকে আরবরা পালবাহী নৌকায় করে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ ও বাংলায় জলপথে যাতায়াত করত। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে চট্টগ্রাম বন্দর আরব বণিকদের নিকট বহুকাল থেকে পরিচিত ছিল। তারা এ বন্দরে অবতরণ করে বাণিজ্যিক পণ্য সংগ্রহ করত। এ বন্দর হয়ে তারা ব্যবসায় উদ্দেশ্যে স্থলপথ ধরে পূর্বদিকে তিব্বত ও চীনে গমন করত। এ ছাড়াও  তারা আরাকান ও বার্মায় সফর করত। ড. এ রহীম তার ঝড়পরধষ ধহফ ঈঁষঃঁৎধষ যরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ গ্রন্থে বাংলার উপকূলবর্তী এলাকায় আরব বণিকদের আগমন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন করেছেন যে, ‘চাটগাঁয়ের সাথে আরবদের সম্পর্ক অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এমনকি চাটগাঁ নামটি আসলে তাদের দেয়া নাম। গঙ্গার ব-দ্বীপ বা শেষ প্রান্তে এই স্থানটির অবস্থিতি বলে আরব বণিকরা এর নাম দেয় শাতিউল গাঙ্গ বা গঙ্গার উপকূল। তাথেকেই কালক্রমে চাটগাও বা চিটাগং এ রূপান্তরিত হয়েছে। চট্টগ্রামের সাথে অতি প্রাচীনকাল থেকে যে আরব বণিকদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তার প্রমাণ স্বরূপ ড. আবদুল করিম স্বীয় চট্টগ্রামে ইসলাম গ্রন্থে আরাকান রাজবংশীয় উপাখ্যান রাদজা তুয়ে বর্ণিত একটি উপাখ্যান উল্লেখ করেছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এ সময়ের শেষ ভাগে কান রাদজাগীর বংশধর মহত ইঙ্গত চন্দয়ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। এ রাজা ২২ বছর রাজত্ব করার পর মারা যান। কথিত আছে, তার সময়ে (৭৮৮-৮১০ খ্রী.) কয়েকটি কুল অর্থাৎ বিদেশী জাহাজ রনবী (বর্তমানে রামরী) দ্বীপের সাথে সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে এবং মুসলমান আরোহীদের আরাকানে পাঠানো হয়। সেখানকার গ্রাম-অঞ্চলে তারা বসবাস শুরু করে।

চট্টগ্রামের সাথে আরব বণিকদের সম্পর্কের প্রমাণস্বরূপ ঐতিহাসিকগণ আরো উল্লেখ করেন যে, কোন এক সময় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম-এর একটি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে রামি বা রামু নামের একটি রাজ্যের অস্তিত্ব বিরাজমান ছিল। সুলায়মান নামের জনৈক্য আরব বণিক বলেন যে, রামির রাজার পঞ্চাশ হাজার হাতি এবং পনের হাজার সৈন্য ছিল। এ প্রসঙ্গে ড. মহর আলী তার ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব সঁংষরসং ড়ভ ইবহমধষ গ্রন্থে উল্লিখিত ঐতিহাসিক তথ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ঔধুরৎধঃ ধষ-জধসর পড়সবং ধভঃবৎ ংধৎধহফরঢ় ধহফ পড়হঃধরহং ঢ়বপঁষবধৎ টহরপড়ৎহ ধহরসধষং ধহফ ষরঃঃষব হধশবফ ঢ়বড়ঢ়ষব, ধষ-গধংঁফর সবহঃরড়হ রঃ ধং ধ ৎরঢ়ধৎরধহ ঈড়ঁহঃৎু ধভঃবৎ ংধৎধহফরঢ় ধহফ ড়হ ঃযব ওহফরধহ ড়পবধহ.

এসব ঐতিহাসিক তথ্য ইঙ্গিত বহন করে যে, জাযিরাতুর রামি নামে যে ভূ-খণ্ডের কথা ইতিহাসে বিবৃত হয়েছে তা ছিল চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। আজকের কক্সবাজারের সমুদ্র সন্নিকটবর্তী রামু সেই রাজ্যরই একটি ুদ্রাংশ। চট্টগ্রামে আরব বণিকদের বেশি আনাগোনা ও বসতী স্থাপন এর ভিত্তিতে তৎকালীন সময়ে সেখানে তাদের দ্বারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়পত্তন হয়েছিল কি না, সে সম্পর্কে অনেক মাতমত পাওয়া যায়। ড. এনামুল হক তার আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন যে, সে সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরবীয় মুসলমানরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন বলে কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন। কিন্তু ড. আবদুল করিম চট্টগ্রামে ইসলাম গ্রন্থে এ ধারণা সংশয়মুক্ত নয় বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে এ কথা সত্য যে, খ্রিস্টীয় ১০ম শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলিম জনপদ গড়ে উঠেছিল এবং এখানকার মুসলমানদের নেতা এমন শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, আরাকানের রাজা তার বিরুদ্ধে সামারিক পদপে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, সে সময় চট্টগ্রামে মুসলমানদের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে না উঠলেও মুসলিম অধ্যুষিত একটি শক্তিশালী জনপদ গড়ে উঠেছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। প্রাচীন কাল থেকে আরবদের যোগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে তাদের গভীর প্রভাব লণীয়। চট্টগ্রামী ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবী শব্দের তুলনায় এর সংখ্যা দ্বিগুণের অধিক বলা যেতে পারে। চট্টগ্রামের ভাষায় ক্রিয়া পদের পূর্বে না সূচক শব্দের ব্যবহার আরবী ভাষার প্রভাবের ফল। এ ছাড়া চট্টগ্রামী লোকদের মুখায়ব অনেকেই আরবদের অনুরূপ বলে মনে করেন। এখানকার অনেক পরিবার নিজেদেরকে আরব বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। চট্টগ্রামের কোন কোন এলাকা বা স্থান আজও আরবী নাম বহন করে চলেছে। এগুলো নাম আরবদের দেয়া নাম। এসব তথ্য চট্টগ্রাম তথা বাংলা উপকূলীয় অঞ্চলের সাথে আরব বণিকদের প্রাচীনতম যোগাযোগের প্রমাণ বহন করে। আরবী ভাষা, আরবীয় সংস্কৃতি ও আরবীয় রক্তের মিশ্রণই এ এলাকায় ইসলামের ব্যপক বিস্তৃতির সহায়ক হয়েছে বলে মনে করা হয়। আরব বণিকরা এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যের উপলে ইসলাম প্রচারের ব্রতী হয়েছিল। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং মহা অভিপ্রায়ে ইসলামের সত্যবাণী চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেমন বিকশিত হয়েছিল তেমনি সূচনা করেছিল এক সোনালী দিগন্তের। ফলে উম্মোচিত হয়েছিল সকল আঁধারের। যে আঁধার ও অমানিশার বুক চিরে বিচ্ছুরণ ঘটেছিল ইসলামের উজ্জ্বল প্রদীপ এবং অভ্যুদ্বয় ঘটেছিল এক নয়া জ্ঞান প্রভার।

আরবদেশ এশিয়া ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এতদঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের চাবিকাঠি ছিল আরবদের হাতে। পূর্বকাল থেকে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক অঞ্চল তাদের নিকট পরিচিত ছিল। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো ডাগামা কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপের স্থল ও বাণিজ্যে আরব বণিকদের পূর্ণ আধিপত্য ছিল। কর্ডোভা থেকে শুরু করে চীন সাগরের উপকূল পর্যন্ত স্থল ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের সমস্ত কেন্দ্রস্থলে তাদের যাতায়াত ছিল। এসব অঞ্চলে তারা একদিকে যেমন ব্যবসা বাণিজ্য করত অপরদিকে ইসলাম প্রচার করত।

বাংলায় আরবদের ব্যবসা বাণিজ্যের যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার কারণ উদঘাটনে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, এখানে পণ্য-সামগ্রীর দাম ছিল খুবই-সস্তা। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা স্বীয় আজায়িবুল আসফার গ্রন্থে লিখেছেন যে, “বাংলা অত্যন্ত একটি বিস্তৃত একটি দেশ। এখানকার প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য চাউল। এখান কার মত কম মূল্যে এতবেশি জিনিস বিক্রি হতো আমি আর কোন দেশে তা দেখিনি। এ দেশে এক রৌপ্য দিনারের বিনিময় পঁচিশ রতল তথা ৭.৫ মণ চাল পাওয়া যেত। দিল্লীর রতল এক পশ্চিমী রতলের সমান হয়ে থাকে। এখানকার দিরহাম আমাদের দেশের দিরহামের সমান, এতে কোন পার্থক্য নেই। আমার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় সে দেশের চালের উপরিউক্ত মূল্য ছিল, ঐ দেশের জনসাধারণের মতে যেটি ছিল সমধিক মূল্যবৃদ্ধির বছর। দিল্লীতে আমার বাড়ির কাছে বসবাসরত একজন দরবেশ আমাকে বলতেন যে, বাংলায় আমার, আমার স্ত্রীর এবং একদাসের জন্য আট দিরহামের খাদ্যসামগ্রী এক বছরের জন্য পর্যাপ্ত হয়ে যেত। সে সময় বাংলায় দিল্লীর মাপ অনুযায়ী আট দিরহামে পাইকারী বাজারে আশি রতল পরিমাণ ধান পাওয়া যেত।”

আরব বণিকরা বাংলা থেকে প্রধানত গরম মসলা, গজদন্ত ও নানাবিধ-মূল্যবান রতœ সম্ভার ক্রয় করে ইউরোপের বাজারে রপ্তানী করত। গরম মসলা উৎপন্ন হত সর›দ্ধীপ ও তার নিকটবর্তী ভারতে দণি এলাকায়। কিন্তু হাতীর জন্য বাংলাদেশ প্রাচীনকাল থেকে বিখ্যাত ছিল। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণকালে বঙ্গরাজের চার সহস্র সুসজ্জিত হস্তি সেনার কথা ইতিহাসে উলেখ দেখতে পাওয়া যায়।  ইবনে বতুতাও আরাকান এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতী প্রাচুর্যের কথা উলেখ করেছেন। ষোড়শ শতকের ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন যে, “বাঙ্গালার পূর্বে ও দেিণ আরখংগ (আরাকান) নামে একটি বিরাট দেশ আছে। চাটগাঁও হচ্ছে তার সামুদ্রিক বন্দর এখানে প্রচুর হাতী পাওয়া যায়।” তাই সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে, আরব বণিকরা হাতীর দাঁত সংগ্রহ করার জন্য যে চট্টগ্রাম বন্দরে আসত তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। হাতীর দাঁত এক মূল্যবান সম্পদ হিসেবে আরবদের কাছে বহুকাল ধরে আদৃত হয়ে আসছে। তাঁরা এ দাঁতগুলো দিয়ে মূল্যবান জিনিস তৈরি করত এবং তা বিশ্ব বাণিজ্য বাজারে রপ্তানী করত।

হাতীর দাঁত ছাড়া আরব বণিকরা বাংলা তথা চট্টগ্রাম থেকে চন্দন কাঠ সংগ্রহ করত। এই কাঠটি তাদের কাছে সুপরিচিত ছিল। এ কাঠের গুণাগুণ হলো, এটি খুব সুগন্ধীযুক্ত কাঠ। এ থেকে আতরের মত ঘ্রাণ বের হয়। পোড়ালে এর ছাই থেকেও সুগন্ধি বের হয়। ফলে এই মূল্যবান কাঠ সংগ্রহ করে তারা বিশ্ব বাজারে বেশি মূল্যে বিক্রি করত। এ ছাড়া তারা বাংলার সূক্ষ্মবস্ত্র মসলিন সংগ্রহ করত। সমকালীন বিশ্বে এই সূক্ষ্মবস্ত্রের খ্যাতি ছিল। বাংলা ছাড়া অন্য কোন অঞ্চলে এরকম মূল্যবান কাপড় পাওয়া যেত না। শুধুমাত্র এ মসলিন ঢাকায় তৈরী হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশের বাজারে রফতানি হতো।

ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগীজ পর্যটক বার্থেমা ও বারবোসা বাংলা সফর করেন। তারা মেঘনা নদীর মোহনায় সন্দ্বীপের উত্তরে বেংগালা বন্দরে উপনীত হয়ে সেখানে বিরাট সংখ্যক মুসলিম সওদাগরকে কাপড়, চিনি ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করতে দেখেন। তাদের বর্ণনামতে, সেকালে সুতী কাপড়, চাল, চিনি, রেশমী কাপড়, আদা, মরিচ, মিরো, বোলান ইত্যাদী ছিল বাংলার রফতানি দ্রব্য। পর্যটক বার্থেমার ভ্রমণ বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আরব বণিকরা বাংলা বন্দর থেকে প্রতিবছর ৫০টি জাহাজ সুতী কাপড়, রেশম ও রেশমী কাপড় বোঝায় করে নিয়ে সাগর পাড়ি দিত। এ ছাড়া বাংলা থেকেই কাপড়, চিনি, আদা, মরিচ ইত্যাদি বোঝায় করে অনেকগুলো জাহাজ নিয়মিত মালয় দ্বীপপুঞ্জ, বার্মা সিংহল করোমন্ডেল উপকূল, আর, পারস্য ও আবিসিনিয়ার পথে সাগর পাড়ি দিত।

বাংলায় আগত আরব বণিকরা ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি ইসলাম প্রচারে ও ব্রতী থাকতেন। তারা ব্যবসাকে শুধুমাত্রা উপল করে মূলত ইসলামের সত্যবাণী প্রচারের জন্য এদেশে আগমন করেছিল। এর প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, সে সময় বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র ছাড়া ও বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের আগমন ঘটেছিল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে পাল বংশের রাজত্ব শুরু হয়। আর এ সময়কাল ছিল আব্বাসীয়দের খিলাফত। ধর্মপাল যখন বাংলাদেশের শাসক, তখন মুসলিম জাহানের খলিফা ছিলেন, হারুনুর রশীদ। তারই খিলাফত কালে নওগাঁ জেলার অন্তর্গত পাহাড়পুরে কয়েকজন আরব বণিক আগমন করেছিল। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার খনন কালে খলিফা হারুনুর রশীদের আমলের একটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। মুদ্রাটিতে ১৭২ হিজরি সন খোদিত ছিল বলে ড. মহর আলী ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব গঁংষরসং ড়ভ ইবহমধষ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। প্রাপ্ত এই মুদ্রাটি- পাহাড়পুরে তাদের আগমন সুনিশ্চিত করে। পাহাড়পুরে তাদের আগমনের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে জনাব আব্দুল মান্নান তালিব লিখেছেন যে, কেবলমাত্র ব্যবসা বাণিজ্য করাই মুসলিম বণিকদের ল ছিল না, এ সংগে তারা নিজেদের উপর অর্পিত ইসলাম প্রচারের দায়িত্বও পালন করে যেতেন। যে সত্যের আলোকে তাঁদের হৃদয়দেশ উদ্ভাসিত হয়েছে- অন্ধকারে নিমজ্জিত দুনিয়ার প্রতিটি মানুষকে সেই আলোকের সন্ধান দেয়া তারা নিজেদের ধর্মীয় ও মানবিক কর্তব্য বলে মনে করতেন। কাজেই এ বণিকদের মধ্য থেকে অতি উৎসাহী কেউ কেউ ধর্মালোচনা ও ধর্ম প্রচারার্থে তৎকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় কেন্দ্র পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার ও ময়নামতির শালবন বিহারে গিয়ে থাকবেন এবং তাঁদের কাছ থেকেই এই মুদ্রাগুলো সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ বিহারসমূহে আমদানি হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে।

ঐতিহাসিক তথ্যবিবরণ থেকে আরো জানা যায় যে, রংপুর শহর থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে লালমনির হাটের সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস মৌজার মজদের আড়া গ্রামে ৬৯ হিজরীতে প্রতিষ্ঠিত এক থানা মসজিদের ধবংসস্তূপ পাওয়া গিয়েছে। কারবলায় নবীদৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মাত্র আট বছরের ব্যবধানে এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের চব্বিশ বছর আগে উমাইয়া শাসনকর্তা প্রথম মারওয়ানের পুত্র আব্দুল মালিকের শাসনামলের একটি ধবংসস্তূপ পাওয়া গিয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। এই প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশন এটিই প্রমাণ করে যে, আরবরা এদেশে ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি ইসলাম প্রচারকে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

সমান্দরে আরব বণিকদের আগমন

অষ্টম এবং নবম শতাব্দীতে আরবীয় বণিকরা সমুদ্রপথে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি বেশি উৎসুক হয়ে পড়ে। তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক দেশেই বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন করে। উল্লেখ্য যে, ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে আরবদের সিন্ধু ও সুলতান বিজয় এবং সেখানে তাদের উপনিবেশ স্থাপনের ফলে ভারতবর্ষ এবং প্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের পথ স্বাভাবিক ভাবেই সুগম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মালাবার, শ্রীলংকা ও সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় তারা বসতি স্থাপন করে। সে সময়ে প্রাচ্যের দেশগুলোতে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য এতটা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল যে, ভারত সাগর এবং বঙ্গোপসাগর যেন তাদের কাছে আরব সাগরেই রূপান্তরিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আরব বণিকরা ভারত ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী বন্দরগুলোতে একচেটিয়া ব্যবসা পরিচালনা করেছিল। তারা এদেশ থেকে পণ্য সামগ্রী কিনে বিশ্ব বাজারে সরবরাহ করত।

আরব বণিকরা তাদের পূর্বদিকের সমুদ্র পরিভ্রমণে সমান্দর, উরনাসিয়ন এবং বার্মীয় সমুদ্র বন্দরগুলোতে আগমন করেছিল এবং সেখানে তারা বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেছিল। এবার আমরা সমান্দর কোথায় অবস্থিত তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতামত পর্যালোচনা করব। উর্দু ভাষায় সমুদ্রকে সমান্দর বলা হয়। আর এখানে সমান্দর বলতে সমুদ্র উপকূলবর্তী এমন বন্দরকে বুঝানো হয়েছে যার পাশেই সমুদ্রে মিষ্টি ও লবণাক্ত পানির দু‘টি ধারা প্রবাহিত। আল-কুরআনের ভাষায় সমুদ্রকে আল-বাহর বলা হয়ে থাকে। আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল-বাহর তথা সমুদ্র বা সাগরের বর্ণনা বিধৃত হয়েছে। যেমন আলাহ তা‘য়ালা বলেন: “আর তিনি (আলাহ) দু‘টি সমুদ্রকে প্রবাহিত করেছেন যে দু‘টির একটির (পানি) মিষ্টি, অপরটির পনি লবনাক্ত ও তিক্ত, এবং উভয়ের মাঝে তিনি একটি শক্তিশালী অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন। (সূরাহ ফুরকান: ৫৩)  সূরা আর রাহমানে বলা হয়েছে-“তিনি দু সমুদ্র পাশাপাশি প্রবাহিত করেছেন। আর উভয়ের মাঝখানে রয়েছে অন্তরায় যা পরস্পরকে অতিক্রম করতে পারে না।”

এ দু‘টি আয়াতে দু‘টি সমুদ্রের কথা উলিখিত হয়েছে এর দ্বারা মিষ্টি ও লোনা পানির যুক্ত সমুদ্রকে বুঝানো হয়েছে। এ পৃথিবীর ভুখণ্ডে কোন কোন স্থানে এই সমুদ্র দু‘টি একত্রে মিলিত হয়েছে। মিঠা পানি ও লবণাক্ত পানি এক সাথে প্রবাহিত হয়েছে। পানি তরল পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও দু‘টি ধারায় প্রবাহমান পানি পরস্পর মিশ্রিত হয় না। আলাহর কি অপরূপ মহিমা। আয়াতে উলিকি দু‘টি সমুদ্র দ্বারা কোন সমুদ্র বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে নানা মত পরিদৃষ্ট হয়। হযরত হাসান ও কাতাদার মতে, দু’টি সমুদ্র দ্বারা পারস্য ও রোম সাগরকে বুঝানো হয়েছে। হিজরি অষ্টম শতকের খ্যাতনামা মুফাসসির আলাউদ্দীন আল খাযিন (মৃত্যু; ৭২৫ টি) লিখেছেন যে, ভারত মহাসাগরে একই সাথে মিষ্টিপানি পানি পাশাপাশি প্রবাহিত হতে দেখা যায়। তাই ভারত সাগরের উপকূলবর্তী স্থান, যেখানে মিষ্টিও লবনাক্ত পানির মিলন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, সেই স্থানকে কোন কোন ঐতিহাসিক ও লেখক সমান্দর বলে উল্লেখ করেছেন। তবে মতটি কতটুকু যুক্তিগ্রাহ্য তা বিবেচনার দাবি রাখে। এ প্রসংগে ড. তারাচাঁদ আল আলাকাতুত তিজারিয়্যাহ বাইনাল হিন্দ ওয়াল ‘আরাব শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন যে, সমান্দর গংগা নদীর মোহনায় অবস্থিত। আরব বণিকরা ভারত মহাসাগরের পথ ধরে চীনের ক্যান্টন বন্দরে যাতায়াত করত। এছাড়া তারা বঙ্গোপসাগর হয়ে গংগার মোহনায় কুঞ্জা ও সমান্দরে আসত। তিনি তাঁর এ বর্ণনায় গংগার তীরে গড়ে উঠা একটি বন্দরকে সমান্দর উলেখ করেছেন। বিখ্যাত আরব ভুগোলবিদ আল-ইদরিসি (মৃত্যু: ১১৬০খ্রি) সমান্দারের বর্ণনা দিতে গিয়ে  লিখেছেন যে, এটি একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং প্রসিদ্ধ শহর। এখানে ব্যবসায় প্রচুর লাভ হয়। এ বন্দর কৌনজে অবস্থিত। এটি এমন এক নদীর তীরে অবস্থিত, যার উৎপত্তিস্থল কাশ্মিরে। এখানে প্রচুর পরিমাণে চাল, গম ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়। এখানে সুমিষ্ট পানিযুক্ত নদী পথে পনের দিনের পথ কামরূ (কামরূপ) থেকে চন্দন কাঠ আনা হত। ইদ্রিসী আরো বলেন যে, সমান্দর নামক এই সুন্দর বাণিজ্যিক শহর মুসালা নামক নদীর তীরে অস্থিত। একে সুগন্ধের নদী বলা হয। আল ইদ্রিসীর এই বিবরণ যৌক্তিক বলে মনে হয় না। কারণ তিনি কখনো ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেননি। সরে জমিনের ভারতের কোন বাণিজ্যকেন্দ্র পরিদর্শনও করেননি। তাই সংগত কারনেই ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে বিশেষ করে সমান্দরের বিবরণ সম্পর্কিত তাঁর উপস্থাপিত তথ্য অনুমান নির্ভর।

বিখ্যাত আরব ভূগোলবিদ ইবনে খুরদাদবিহ (মৃত্যু: ৯১২ খ্রী.) স্বীয় আল-মাসালিক ওয়াল মামালিক গ্রন্থে আরব দেশ থেকে চীন সাম্রাজ্য পর্যন্ত বাণিজ্যিক পথ ও সামুদ্রিক বন্দর সমূহের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, কামরুপ থেকে সমান্দর এর দুরুত্ব হরো সুমিষ্ট পানিবিশিষ্ট নদীপথে ১৫/২০ দিনের পথ। এখানে প্রচুর পরিমাণে চাল উৎপাদিত হয়। এছাড়া চন্দন কাঠও এখানে পাওয়া যায়। ড. আবদুল করিম এই স্থানটি নির্ণয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের মতামত উল্লেখ করে বলেন, তাদের পরিবেশিত তথ্যে উপকূলবর্তী যে বাণিজ্যকেন্দ্র সমূহের নাম বিধৃত হয়েছে, তার মধ্যে সমান্দর বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী একটি বাণিজ্যকেন্দ্র বলে মনে হয়। ড. কাজী দীন মুহম্মদ বাংলদেশে ইসলামের আবির্ভাব ও ক্রমবিকাশ নিবন্ধে উলেখ করেছে যে, “অনেক ঐতিহাসিকের মতে সমান্দরকে চট্টগ্রাম বন্দর মনে করা হয়। তবে কারো কারো মতে, এটি সুবর্ণ গ্রাম বা সোনারগাঁও হতে পারে।”

আল-কুরআনে বর্ণিত হাযা আযবুন ফুরাতুন ওয়া হাযা মিলহুন উজাজ এর অর্থ হলো এক সমুদের সুমিষ্ট পানি ও আরেকটি লবণাক্ত পানি” এ দুই ধারার পানি কোন সমুদ্রের মিলিত হয়েছে তা উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করলে দেকা যায় যে, বঙ্গোপসাগরে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। জনাব এ. কে এম মুহিউদ্দীন চট্টগ্রামে ইসলাম গ্রন্থে লিখেছেন যে, এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাব্বির আহমদ উছমানী বঙ্গোপসাগর থেকে আলাহর মহিমার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। তিনি দারুল ‘উলুম দীওবন্দ মাদরাসায় অধ্যাপনা কালে এক বাঙালি ছাত্র তার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, বঙ্গোপসাগরে এমন একটি স্থান আছে, যে স্থান থেকে দুই ধারার পানি উত্থিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এ স্থানটি কোথায়? এর জবাবে বলা যায় যে, চট্টগ্রাম ভূখণ্ড ও সন্দ্বীপের মাঝখানে উত্তর দেিণ লম্বালম্বিভাবে যে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে সেখানে সুমিষ্টি ও লবনাক্ত দু’ধারার পানি পাশাপাশি প্রবাহিত হয় এই উপকূলবর্তী এলাকাকেই সমান্দর হয় বলা হয়। এ সমান্দর বন্দরে আরব বণিকরা তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। আরব ভূগোলবিদ আল-ইদরিসির বর্ণনা মতে, সমান্দর ছিল মুসলিম আরবদের প্রাচ্য বাণিজ্য পণ্য সংগ্রহের একটি প্রধান বন্দুর। তারা এখান থেকে চাল, আগর ও চন্দ্রন কাঠ সংগ্রহ করত। আরব বণিকরা এই এই বাণিজ্য কেন্দ্রে শুধু ব্যবসাই করেননি; তারা এখানে ইসলাম প্রচারেও ব্রতী হয়েছিলেন। স্থায়ী নিবাস ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনের মাধ্যমে তারা এখানে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছিল। তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় যে স্থানটি হিন্দু অধ্যুষিত ছিল তা মুসলিম এলাকায় পরিণত হয়।

সন্দ্বীপে আরব বণিকদের আগমন

সমান্দরে আরব বণিকদের আগমনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সুদূর চীন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় যে ইসলামের আগমন ও প্রচারের পথ সুগম হয়, তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই কোন কোন ঐতিহাসিক সমান্দর ও সন্দ্বীপকে একই স্থান হিসেবে মনে করেছেন। তবে সন্দ্বীপের প্রাচীনত্ব ও ইসলাম প্রচারের প্রাচীন কেন্দ্র হিসেবে এই দ্বীপের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সমান্দর এবং সন্দ্বীপ এক জায়গা নয়; বরং সন্দ্বীপ একটি প্রাচীন দ্বীপ। সপ্তম শতাব্দী থেকে তিন হাজার বছরের প্রাচীন এই দ্বীপের সাথে আরব বণিকদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সে সময় থেকে আরব বণিকরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন ও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ১৩৪৫ খ্রীষ্টাব্দে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা চীন যাওয়ার পথে এই দ্বীপ সফর করেন। তিনি এ সময় চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ ও উপকূলীয় দ্বীপসমূহে অসংখ্য আরবকে বসবাস করতে দেখেন। ১৪১২ খ্রীষ্টাব্দে সুদূর বাগদাদ থেকে হযরত শাহ আলী আল-বাগদাদী নামে জনৈক মুসলিম সাধক সন্দ্বীপে আগমন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপীয় পরিব্রাজক পাচাচ সন্দ্বীপ সফর করেছিলেন বলে এ,কে, এম মহিউদ্দনি স্বীয় চট্টগ্রামে ইসলাম নামক গ্রন্থে একটি তথ্যভিত্তিক বিবরণ দিয়েছেন। তিনি তাতে উলেখ করেছেন যে, পরিব্রাজক মি. পাচাচ সন্দ্বীপ সফর করে এখানকার অধিবাসীদেরকে মুসলমান বলে উলেখ করেন। তিনি এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীকে ধর্মভীরু হিসেবে দেখতে পেয়েছেন এবং তাদের উপসানার জন্য যে সকল মসজিদ ছিল সেগুলো ২০০ বছরেরও অধিক প্রাচীন বলে উলেখ করেন। তিনি আরো লিখেছেন যে, ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ভিনিশিয়ান ভ্রমণকারী সিজার ফ্রেডারিক সন্দ্বীপে আগমন করেন। তিনি এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে এখানে এসেছিলেন। সন্দ্বীপ সম্পর্কে তার উপস্থাপিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, দ্বীপের অধিবাসীগণ ছিলেন মূর। মূর কাদেরকে বলা হয় এ নিয়ে দু’ধরনের মত পাওয়া যায়। প্রথম মতানুযায়ী ইউরোপীয়রা সকল মুসলমানকেই মূর বলে আখ্যায়িত করত। অপর মতানুযায়ী আরবদেরকে মূর বলা হত। ফ্রেডারিক এই দ্বীপে তুরষ্কের সুলতানকে জাহাজ নির্মাণ করতে দেখেছেন এবং সন্দ্বীপকে একজন মূরীয় সুলতানের অধীন বলে উল্লেখ করেছেন। এ সময় সন্দ্বীপ ছিল একটি উর্বর ভূমি। আরব বণিকদের ব্যবসায়িক সংযোগ স্থাপনের কারণে এটি শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য বন্দর হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। ইংরেজ পরিব্রাজক স্যার টমাস হার্বাট সন্দ্বীপে আগমন করেছিলেন এবং সরেজমিনে পরিদর্শন করে যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখানো হয়েছে যে, তৎকালীন বিশ্বে সন্দ্বীপ ছিল একটি উত্তম বন্দর। কাল-পরিক্রমায় ধর্মপ্রচারক ও সূফী সাধকদের আগমনের ফলে এই বন্দর নগরী এক গৌরবময় স্থানে পরিণত হয়। এ জন্য সন্দ্বীপকে বার আউলিয়ার দেশ অথবা দ্বিতীয় আরব বলে কোন কোন ঐতিহাসিক অভিহিত করেছেন।

হযরত মু’আবিয়ায় খিলাফতকাল থেকে নৌ অভিযানের সূচনা হওয়ায় আরবদের এক নবযুগের সৃষ্টি হয়। আরবীয় মুসলমানরা একদিকে যেমন বিভিন্ন দেশে নৌ পরিচালনা করেছিল অপরদিকে তারা শান্তিপূর্ণ নৌ ভ্রমণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আরব পর্যটক সুলায়মান সায়রাফী আরবদের নৌযান পরিচালনা সম্বন্ধে তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তাতে দেখা যায় যে, আরবরা পারস্য সাগর থেকে বের হয়ে ভারত মহাসাগরে অবতরণ করার পর বঙ্গোপসাগর অতিক্রমকালে বাংলার বিখ্যাত বন্দর চট্টগ্রাম ও সিলেট পর্যটন করে। ঐতিহাসিক আল-ইদ্রীসী, আল-মাস’উদী, ইবনু- খুরদাদাবীহ প্রমুখ আরবীয় ভৌগোলিক ও পরিব্রাজকদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বঙ্গোপসাগরে পরিভ্রমণকালে এই আরব নাবিকদের অবস্থানের কেন্দ্র হতো সিলেট এবং চট্টগ্রাম। এছাড়া তারা মেঘনার মোহনাস্থ সন্দ্বীপ ও অন্যান্য নিকটস্থ এলাকাসমূহে তাদের উপনিবেশ ও প্রভুত্ব বিস্তার করেছিল।

তৎকালীন যুগে সন্দ্বীপে প্রচুর পরিমাণে আগর কাঠও সূতিবস্ত্র পাওয়া যেত, যা আরবীয় ভৌগোলিক ও ভ্রমণকারীদের বর্ণনা থেকে জানা যায়। সে সময় শুধু সন্দ্বীপেই নয়, সমগ্র বাংলাদেশ একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত হওয়ায় সমকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তথা মক্কা-মদীনা, বাগদাদ, ইরাক, দামিশক, সিরিয়া, মিসর, ইরান, তুরস্ক প্রভৃতি দূরদেশ থেকে লোকেরা এখানে জমায়েত হত। বিশেষ করে তারা চট্টগ্রাম সমান্দর ও সন্দ্বীপে আগমন করত। এ সময় সন্দ্বীপ বাংলা বন্দর নামেও খ্যতি লাভ করে। শহরে সন্দ্বীপ ও বেঙ্গলা বলে সন্দ্বীপে যে দুটি শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা পর্যটক ও ঐতিহাসিকগণের বিবরণ থেকে জানা যায়। চৈনিক পর্যটক বার্থেমা বা বার্বোশা লিখেছেন যে, মেঘনা নদীর মোহনায় এই বেঙ্গলা (সন্দ্বীপ) বন্দরে অনেক পারসিক ও আবিসিনীয় মুসলমানদেরকে দেখা গিয়েছে। পণ্ডিতগণ এই বেঙ্গলা বন্দর সন্দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত বলে মনে করেন।

হিজরী নবম শতাব্দীতে অনেক আরব বণিক এই সন্দ্বীপ আগমন করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে এবং ইসলাম প্রচারে ব্রতী হয়। এ অঞ্চলে মুসলিম বিজেতাদের আগমনের অনেক পূর্বে আরব বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের আগমন ঘটে। এ প্রসঙ্গে ড. নুরুল হক- এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার অৎধন ৎবষধঃরড়হং রিঃয ইধহমষধফবংয গ্রন্থে লিখেছেন যে, অমধরহ, ঃযব রংষধহফং ড়ভ ঝধহফারঢ়, ঐধঃরধ ধহফ পড়ধংঃধষ ঃবৎৎরঃড়ৎরবং ড়ভ ইবহমধষ বিৎব হড়ঃ পড়হয়ঁবৎবফ নু গঁংষরস ৎঁষবৎং রহ ঃযব ভরভঃববহঃয পবহঃঁৎু. ণবঃ যিবহ াধৎঃযবসধ ধহফ ইধৎনড়ংধ ারংরঃবফ ঃযব পরঃু ড়ভ ইবহমধষধ ধঃ ঃযব সড়ঁঃয ড়ভ ঃযব সবমযহধ ড়হ ঃযব পড়ধংঃ ড়ভ ঃযব ইধু ড়ভ ইবহমধষ, ঃযবু ংড়সব সধহু অৎধন, ঢ়বৎংরধহ ধহফ অনুংংরহরধহ সবৎপযধহঃং ধহফ ড়ঃযবৎ গঁংষরসং ষরারহম ঃযবৎব যড়ি ফরফ ঃযবংব গঁংষরসং পড়সব ঃযবৎব? ঞযরং ংঁঢ়ঢ়ড়ংবং ঃযধঃ ঃযবু পধসব ধহফ ংবঃঃষবফ ঃযবৎব রহ ঃযব পড়ঁৎংব ড়ভ ঃযবরৎ ঃৎধফব রিঃয ঃযব ঝবধ ঢ়ড়ৎঃং ড়ভ ইবহমধষ.

সুতরাং বলা যায় যে, ইসলাম প্রচারক সাহাবী ও আরব বণিকদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে এবং তাদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এদেশে ইসলামী দা’ওয়াতের সূত্রপাত হয়। তাদের নিরলস প্রচেষ্টা ও অকান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এদেশে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়। তাঁরা যদি নিঃস্বার্থভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য নিজেদেরকে নিয়োজিত না করতেন তাহলে ইসলাম আজ আরব উপদ্বীপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত এবং বিশ্বের দিগদিগন্তে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হতো না। এ সমস্ত ঈমানের বলে বলীয়ান মরদে মুজাহিদের অবিরাম প্রচেষ্টার ফলে রাসূলের (সা.) ইন্তিকালের মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যে ইসলাম অর্ধগোলার্ধে বিস্তৃত লাভ করে। পার্থিব কোন স্বার্থ, লোভ-লালসা ইসলাম প্রচারের পথ থেকে তাদেরকে দূরে সরাতে পারেনি। এপথে সৃষ্টি করতে পারেনি কোন প্রতিবন্ধকতা। দেশ কালের সীমারেখা তাদেরকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি। তাঁরা এ পথে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তারা এ পথকে তাঁদের জীবনের সোনালী দিনগুলোকে উপহার দিয়েছেন। পৃথিবীর সর্বত্র ইসলামের প্রচার ও প্রসারে তারাই ছিলেন পথিকৃৎ। ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলার পথগুলো তাদের সাহসী পদভারে উজ্জ্বলতায় আজ বিকশিত, চিরন্তনতায় উদ্ভাসিত এবং চির অম্লিত।

সুত্র:

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

১টি মন্তব্য

  1. এই লিংটি দেখুন। বাংলাদেশে হিজরি ৬৯ সালে মসজিদ স্থাপিত হয়েছিলো যা সাহাবা (রা) করেছিলেন। বিস্তারিত লিংকে: http://archive.thedailystar.net/beta2/news/ruins-of-a-lost-mosque-2/
    সুফিবাদী ভন্ডদের কথা আর চলবে না। তারা বলে যে, সুফিরা ইসলাম নিয়ে আসছে উপমহাদেশে। আসলে ওরা ভন্ড। আল্লাহ তা প্রমান করে দিয়েছেন।

    জাজাকাল্লাহু খাইরান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member