ইসলামে মুরাকাবা’র বিধান

রচনায়: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

মুরাকাবা কাকে বলে

মুরাকাবা অর্থ হল : এমনভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদাত-বন্দেগী করা যেন আপনি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছেন। যদি এ অবস্থা আপনার অর্জিত না হয়, তা হলে এমন ভাব নিয়ে তাঁর ইবাদত করা যে, তিনি অবশ্যই আপনাকে দেখতে পাচ্ছেন। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলা হয় মুরাকাবা।

মুরাকাবার আভিধানিক অর্থ হল পর্যবেক্ষণ করা।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ ﴿218﴾ وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ ﴿219﴾

‘‘তুমি যখন সালাতে দাড়াও তিনি তোমাকে দেখেন। আর সিজদাকারীদের মধ্যে আপনার নড়াচড়াও দেখেন।’’ (সূরা আশ-শুআরা, আয়াত : ২১৮-২১৯)

তিনি আরো বলেনঃ

وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ

‘‘তোমরা যেখানেই থাকো তিনি তোমাদের সাথে আছেন।’’ (সূরা আল হাদীদ, আয়াত : ৪)

তিনি আরো বলেনঃ

إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ

‘‘আল্লাহর কাছে আকাশ ও পৃথিবীর কোন কিছুই গোপন থাকে না।’’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৫)

তিনি আরো বলেনঃ

إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ

‘‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক কড়া দৃষ্টি রাখছেন।’’ (সূরা আল ফাজর, আয়াত ১৪)

তিনি আরো বলেনঃ

يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ

‘‘তিনি জানেন চক্ষুসমূহের খেয়ানত ও অন্তরসমূহ যা গোপন রাখে।’’ (সূরা আল মুমিন, আয়াত ১৯)

এ আয়াতসমূহ থেকে আমরা যা শিখতে পারিঃ

আলোচিত পাঁচটি আয়াতই মুরাকাবা সম্পর্কিত।

প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ এমন এক সত্তা তুমি সালাতে দাড়ালে যিনি তা প্রত্যক্ষ করেন। সেজদা অবস্থায় তোমার নড়াচড়াগুলোও তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না।

দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ ‘‘তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সাথে আছেন।’’ এর অর্থ হল, তিনি সর্বক্ষণ, সর্বাবস্থায় ও সর্বত্র তোমাদের পর্যবেক্ষণ করেন। তার জ্ঞান, দর্শন, শ্রবন থেকে তোমরা কেহ বাহিরে নও।

এ আয়াতের অর্থ এ নয় যে, মহান আল্লাহর জাত বা সত্তা তোমাদের সাথে সাথে থাকেন। নাউজুবিল্লাহ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সত্তা আরশের উপর সমাসীন। এ সম্পর্কে আল কুরআনে বহু আয়াত রয়েছে। তিনি সর্বত্র বিরাজমান নন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, দর্শন, শ্রবন সর্বত্র বিরাজমান। জগতসমূহের কোথাও সামান্য অনু পরিমাণ বস্ত্ত তার পর্যবেক্ষণের বাহিরে নয়। ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’ বলে যে আকীদা শিক্ষা দেয়া হয় তা সঠিক নয়। সঠিক আকীদা-বিশ্বাস হল, আল্লাহ তাঁর আরশে সমাসীন। আর সারা জগতের সব কিছুই তার জ্ঞান, দর্শন শ্রবনের আওতাভুক্ত। তাই ইমাম নববী রহ. এ আয়াতটিকে মুরাকাবা বা আল্লাহ তাআলার পর্যবেক্ষণ বিষয়ে এখানে উল্লেখ করেছেন।

তৃতীয় আয়াতের শিক্ষা হল, আসমানসমূহ ও জমীনের কোন বস্তু ও বিষয় তাঁর কাছে গোপন নয়।

চতুর্থ আয়াতের শিক্ষা হল, যুদ্ধের সময় যুদ্ধের ঘাঁটিতে প্রহরীরা ওঁৎ পেতে বসে কড়া দৃষ্টিতে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে। আল্লাহও কড়া দৃষ্টিতে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।

পঞ্চম আয়াতে বলা হয়েছে, এমন অনেক বিষয় আছে যা মানুষ সতর্ক থাকার পরেও তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। আবার কোন কোন বিষয় আছে যা পর্যবেক্ষণ করা তাদের সাধ্যের বাহিরে থাকে। এমন সব বিষয়ও আল্লাহর পর্যবেক্ষণের বাহিরে নয়। মানুষ কোথায় চুপে চাপে তাকায়, সে কখন কি কল্পনা করে, নিয়্যত করে ও গোপন রাখে এগুলো অন্য মানুষ জানতে না পারলেও আল্লাহ তাআলা ভালভাবে জানেন।

1-  عَنْ عُمرَ بنِ الخطابِ ، رضيَ اللَّهُ عنه ، قال: «بَيْنما نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْد رسولِ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ، ذَات يَوْمٍ إِذْ طَلع عَلَيْنَا رجُلٌ شَديدُ بياضِ الثِّيابِ ، شديدُ  سوادِ الشَّعْر ، لا يُرَى عليْهِ أَثَر السَّفَرِ ، ولا يَعْرِفُهُ منَّا أَحدٌ ، حتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ، فَأَسْنَدَ رَكْبَتَيْهِ إِلَى رُكبَتيْهِ ، وَوَضع كفَّيْه عَلَى فخِذيهِ وقال : يا محمَّدُ أَخبِرْنِي عن الإسلام فقالَ رسولُ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم : الإِسلامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ، وأَنَّ مُحَمَّداً رسولُ اللَّهِ وَتُقِيمَ الصَّلاَةَ ، وَتُؤتِيَ الزَّكاةَ ، وتصُومَ رَمضَانَ ، وتحُجَّ الْبيْتَ إِنِ استَطَعتَ إِلَيْهِ سَبيلاً.

قال : صدَقتَ . فَعجِبْنا لَهُ يسْأَلُهُ ويصدِّقُهُ ، قَالَ : فَأَخْبِرْنِي عن الإِيمانِ . قَالَ: أَنْ تُؤْمِن بِاللَّهِ وملائِكَتِهِ ، وكُتُبِهِ ورُسُلِهِ ، والْيومِ الآخِرِ ، وتُؤمِنَ بالْقَدَرِ خَيْرِهِ وشَرِّهِ . قال: صدقْتَ قال : فأَخْبِرْنِي عن الإِحْسانِ . قال : أَنْ تَعْبُدَ اللَّه كَأَنَّكَ تَراهُ . فإِنْ لَمْ تَكُنْ تَراهُ فإِنَّهُ يَراكَ قَالَ : فَأَخْبِرْنِي عن السَّاعةِ . قَالَ : مَا المسْؤُولُ عَنْهَا بأَعْلَمَ مِن السَّائِلِ . قَالَ : فَأَخْبرْنِي عَنْ أَمَاراتِهَا . قَالَ أَنْ تلدَ الأَمَةُ ربَّتَها ، وَأَنْ تَرى الحُفَاةَ الْعُراةَ الْعالَةَ رِعاءَ الشَّاءِ يتَطاولُون في الْبُنيانِ ثُمَّ انْطلَقَ ، فلبثْتُ ملِيًّا ، ثُمَّ قَالَ : يا عُمرُ ، أَتَدرِي منِ السَّائِلُ قلتُ : اللَّهُ ورسُولُهُ أَعْلمُ قَالَ : فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعلِّمُكم دِينِكُمْ » رواه مسلمٌ.

হাদীস – ১. উমার ইবনে খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বসে ছিলাম। তখন হঠাৎ একজন লোক আসল। লোকটির পোশাক ছিল সাদা ধবধবে। তার কেশগুলো ছিল কাল কুচকুচে। সফর করে এসেছে এমন কোন আলামত তার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল না। আবার আমাদের মধ্যে তাকে কেহ চেনেও না। সে সোজা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গিয়ে তার দু হাটু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দু হাটুর সাথে লাগিয়ে, নিজ হাত দুটো রানের উপর রেখে বসে গেল। এবং বলল, ‘‘হে মুহাম্মাদ! ইসলাম সম্পর্কে আমাকে বলুন।’’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘‘ইসলাম হল, তুমি স্বাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। সালাত কায়েম করবে। যাকাত প্রদান করবে। রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে। আর যদি মক্কায় যেতে সামর্থ রাখো তাহলে হজ করবে।’’ লোকটি বলল, ‘‘আপনি সত্য বলেছেন।’’ আমরা আশ্চর্য হলাম যে, সে নিজেই প্রশ্ন করছে আবার নিজেই তা সত্যায়ন করছে।

তারপর লোকটি বলল, ‘‘আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।’’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি আল্লাহর প্রতি, তার ফেরেশতাদের প্রতি, তার কিতাবসমূহের প্রতি, তার রাসূলদের প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। আরো বিশ্বাস করবে তাকদীরের ভাল ও মন্দ (আল্লাহর পক্ষ থেকে) নির্ধারিত।’’

লোকটি বলল, ‘‘আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।’’ তিনি বললেন, ‘‘এমনভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি তাকে দেখতে না-ও পাও তাহলে তিনি নিশ্চয় তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’’

লোকটি বলল, ‘‘আমাকে কেয়ামত সম্পর্কে অবহিত করুন।’’ তিনি বললেন, ‘‘যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে সে প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশী জানে না।’’

লোকটি বলল, ‘‘তাহলে আমাকে কেয়ামতের আলামত সম্পর্কে বলুন।’’ তিনি বললেন, ‘‘দাসী তার মুনিবকে প্রসব করবে। আর খালি পা, উলঙ্গ, দরিদ্র ছাগলের রাখালদের তুমি সুউচ্চ প্রাসাদে বসে অহংকার করতে দেখবে।’’

এরপর লোকটি চলে গেল। আমি বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘‘হে উমার! তুমি কি জান এ প্রশ্নকারী কে?’’ আমি বললাম, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন।’’ তিনি বললেন, ‘‘সে হল জিবরীল। সে তোমাদের কাছে এসেছিলো তোমাদের ধর্ম শেখাতে।’’ বর্ণনায়ঃ মুসলিম

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ

এক.ইসলাম ও ঈমানের পরিচয় সম্পর্কে এটি সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ হাদীস। হাদীসটি ‘হাদীসে জিবরীল’ নামে পরিচিত।

দুই. ইসলামের মূল ভিত্তি হল পাঁচটি।

তিন. ঈমানের রোকন বা মূল বিষয় হল ছয়টি।

চার. ইহসান শব্দের অর্থ হল ‘সুন্দর করা’। পরিভাষায় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী সুন্দরভাবে আদায় ও তার সৃষ্টিকুলের জন্য কল্যাণকর ও সুন্দর আচরণ-কে ইহসান বলে। এ হাদীসে ইহসান বলতে ইবাদাতের ক্ষেত্রের ইহসানকে বুঝান হয়েছে। ইবাদতের ক্ষেত্রের এই ইহসান-কে বলা হয় মুরাকাবা। যার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এ হাদীসে। আর বিষয় শিরোনামের সাথে হাদীসের সম্পর্ক এখানেই।

পাঁচ. কেয়ামত সংঘটিত হবে এ মর্মে বিশ্বাস রাখা ঈমানের অঙ্গ।

ছয়. কেয়ামত কবে সংঘটিত হবে তা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জানা ছিল না। কোন মানুষও তা জানে না। যে পাঁচটি বিষয় আল্লাহ ব্যতীত কেহ জানে না বলে আল-কুরআনের সূরা লুকমানের সর্বশেষ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার তারিখ।

সাত. কেয়ামতের কিছু আলামত আছে।

আট. ‘দাসী তার মুনিবকে প্রসব করবে’ এর দুটো অর্থ হতে পারে। অধিকাংশের মত হল, এ কথার দ্বারা যুদ্ধ-বিগ্রহ বেশী হবে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় মত হল, সন্তান তার মাতা-পিতার সাথে মুনিব সুলভ আচরণ করবে। মাতা-পিতার অবাধ্য হবে।

নয়. সমাজের অভদ্র ও নীচু শ্রেনির লোকজনের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করা কেয়ামতের একটি আলামত।

নয়. কোন বিষয় শিক্ষা দেয়া বা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নাটক বা অভিনয় করা জায়েয।

2- عن أبي ذَرٍّ جُنْدُبِ بْنِ جُنَادةَ ، وأبي عبْدِ الرَّحْمنِ مُعاذِ بْنِ جبل رضيَ اللَّه عنهما ، عنْ رسولِ اللَّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم ، قال : « اتَّقِ اللَّهَ حَيْثُمَا كُنْتَ وأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحسنةَ تَمْحُهَا، وخَالقِ النَّاسَ بخُلُقٍ حَسَنٍ » رواهُ التِّرْمذيُّ وقال : حديثٌ حسنٌ .

হাদীস – ২. আবু জর ও মুআজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘তুমি যেখানেই থাক আল্লাহ-কে ভয় কর। আর অসৎ কাজ করার পর সৎ কাজ করবে তাহলে সৎ কাজ অসৎ কাজটিকে মিটিয়ে দেবে। মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ করবে।’’ বর্ণনায়ঃ তিরমিজী, তিনি হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ

এক. সর্বক্ষেত্রে, সর্বদা, সব কাজ, কথা ও চিন্তা-ভাবনায় আল্লাহ-কে ভয় করে চলা। এর নাম তাকওয়া। এর জন্য দরকার মুরাকাবা করা। আমি যখন সর্বদা আল্লাহ-কে দেখছি বা আল্লাহ আমাকে দেখছেন তখন তাকে ভয় করে ভাল কাজ করতে হবে।

দুই. তাকওয়া ও মুরাকাবার মধ্যে সম্পর্ক হল, মুরাকাবা করলে তাকওয়া অবলম্বন করা সহজ হয়।

তিন. একটি অসৎ কাজ করলে সৎ কাজ করতে হয়। যাতে অসৎ কাজটি মিটে যায়। এর জন্যও এক ধরনের মুরাকাবা বা আত্নসমালোচনা দরকার। হিসাব করতে হবে আমি কতটি খারাপ কাজ করেছি। আর ভাল কাজ কয়টি করলাম। এ হিসাবটাকে মুহাসাবা বলা হয়। মুরাকাবা আর মুহাসাব একটি অপরটির সহায়ক।

চার. ভাল ও সৎকর্ম খারাপ ও অসৎকর্মকে দূর করে দেয়। যেমন আল্লাহ আআলা বলেনঃ

وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ

‘‘আর তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দু’প্রান্তে এবং রাতের প্রথম অংশে। নিশ্চয়ই ভালকাজ মন্দকাজকে মিটিয়ে দেয়। এটি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য উপদেশ।’’ সূরা হুদ, আয়াত ১১৪

পাঁচ. সকল মানুষের সাথে সদাচরণ ও সুন্দর ব্যবহার করতে হবে। সুন্দর চরিত্র হল ইসলামের সবচেয়ে বড় পরিচায়ক।

3- عن ابنِ عبَّاسٍ ، رضيَ اللَّه عنهمَا ، قال : « كُنْتُ خَلْفَ النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم يوْماً فَقال : « يَا غُلامُ إِنِّي أُعلِّمكَ كَلِمَاتٍ : « احْفَظِ اللَّهَ يَحْفَظْكَ  احْفَظِ اللَّهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ ، إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَل اللَّه ، وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ ، واعلَمْ : أَنَّ الأُمَّةَ لَو اجتَمعتْ عَلَى أَنْ ينْفعُوكَ بِشيْءٍ ، لَمْ يَنْفعُوكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَد كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ ، وإِنِ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوك بِشَيْءٍ ، لَمْ يَضُرُّوكَ إِلاَّ بَشَيْءٍ قد كَتَبَهُ اللَّه عليْكَ ، رُفِعَتِ الأقْلامُ ، وجَفَّتِ الصُّحُفُ».

رواهُ التِّرمذيُّ وقَالَ : حديثٌ حسنٌ صَحيحٌ

হাদীস – ৩. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিছনে (যানবাহনে) বসা ছিলাম। তিন বললেনঃ ‘‘হে বালক! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিক্ষা দিচ্ছি : আল্লাহ-কে হেফাজত কর, তা হলে তিনি তোমাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহ-কে হেফাজত কর, তা হলে তাঁকে তোমার সামনে পাবে। যখন কোন কিছু চাবে তখন আল্লাহর কাছে চাবে। যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে। আর জেনে রাখ! সমগ্র জাতি যদি একত্র হয় তোমার উপকার করার জন্য, তা হলে তোমাকে উপকার করতে পারবে না ততটুকু ছাড়া যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে দিয়েছেন। সমগ্র জাতি যদি তোমার ক্ষতি করার জন্য একত্র হয় তা হলে তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না ততটুকু ছাড়া যতটুকু আল্লাহ তোমার বিপক্ষে লিখে দিয়েছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং খাতা শুকিয়ে গেছে। বর্ণনায়ঃ তিরমিজী

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ

এক. এ হাদীসটি আল্লাহ তাআলার মুরাকাবা সম্পর্কে একটি মৌলিক হাদীস।

দুই. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব জাতির শ্রেষ্টতম শিক্ষক। তিনি সর্বদা মানুষকে শিক্ষা দিতে নিবেদিত ছিলেন। এমনকি যানবাহনে বসেও।

তিন. আল্লাহ-কে রক্ষা করার অর্থ হলঃ তার আদেশ-নিষেধ পালন। তার সন্তুষ্টি অসন্তুষ্টির প্রতি খেয়াল রেখে সকল কাজ করা। তাকে সর্বদা ভয় করে চলা। সব কাজে তার সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের লক্ষে পরিণত করা।

চার. এভাবে আল্লাহ-কে রক্ষা করলে তাঁকে সর্বদা সামনে পাওয়া যাবে।

পাঁচ. আল্লাহকে রক্ষা করার আরো কয়েকটি বিষয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করে দিলেন। তা হল, যখন কোন কিছু চাবে তখন আল্লাহর কাছে চাবে। যখন কোন বিপদ মুসীবত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করবে। এটা তাওহীদের শিক্ষা।

ছয়. আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে। অন্যের কাছে নয়। এর অর্থ হল যে সকল মানুষ আপনাকে বিপদে সাহায্য করার সামর্থ রাখে তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু বিপদে পড়ে কোন মৃত নবী- রাসূল, ফেরেশতা, পীর-আওলিয়া, মাজার, দেব-দেবীর কাছে সাহায্য চাওয়া শিরক।

সাত. তাকদীরের প্রতি কিভাবে বিশ্বাস করতে হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে-নির্দেশনা দিয়েছেন এ হাদীসে। কোন মানুষ কাউকে ক্ষতি করতে পারে না, পারে না কারো উপকার করতে। যদি তাকদীরে তা আল্লাহ না লিখে থাকেন।

আট. তাকদীরে যা লেখা হয়েছে মানুষ তা কিছুই পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। তা অবশ্যই অর্জিত হবে। ‘কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে আর খাতা শুকিয়ে গেছে’ কথা দ্বারা এটা বুঝানো হয়েছে। কিন্তু মানুষ তাকদীর সম্পর্কে যখন জানে না তখন তাকে সর্বদা নিজের জন্য যা কিছু ভাল, উপকারী ও কল্যাণকর, তা অর্জন করতে চেষ্টা চালাবে। আর এর জন্যই সৎকর্ম করতে হবে অসৎকর্ম থেকে ফিরে থাকতে হবে।

4- عنْ أَنَس رضي اللَّهُ عنه قالَ : « إِنَّكُمْ لَتَعْملُونَ أَعْمَالاً هِيَ أَدقُّ في أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ ، كُنَّا نَعْدُّهَا عَلَى عَهْدِ رسولِ اللَّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم مِنَ الْمُوِبقاتِ » رواه البخاري . وقال : « الْمُوبِقَاتُ » الْمُهْلِكَاتُ .

হাদীস – ৪. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘‘তোমরা এমন সব কাজ কর যা তোমাদের দৃষ্টিতে চুল থেকেও বেশী হালকা অথচ আমরা তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে সেগুলোকে মারাত্নক বিধ্বংসী হিসাবে গণ্য করতাম।’’

বর্ণনায়ঃ বুখারী

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ

এক. সাহাবীদের মুরাকাবা ও পরবর্তি লোকদের মুরাকাবার পার্থক্য দেখা গেল এ হাদীসে।

দুই. পাপ যতই ছোট হোক তা হালকা ভাবা ঠিক নয়।

5- عَنْ أبي هريْرَةَ ، رضي اللَّه عنه ، عن النبيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم قال : إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَغَارُ ، وَغَيْرَةُ اللَّهِ تَعَالَى ، أنْ يَأْتِيَ الْمَرْءُ مَا حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ » متفقٌ عليه .

হাদীস – ৫. আবু হুরাইরা রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ ‘‘আল্লাহ তাআলা আত্ন-মর্যাদাবোধ পোষণ করেন। আর তার আত্নমর্যাদাবোধ ক্ষুন্ন করা হল, তিনি যা হারাম করেছেন তাতে লিপ্ত হওয়া।’’

বর্ণনায়ঃ বুখারী ও মুসলিম

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ

এক. হারাম বিষয় হল আল্লাহ তাআলার আত্ন-মর্যাদাবোধের প্রতীক। তাই কেহ হারাম কথা বা কাজে লিপ্ত হয়ে পড়লে আল্লাহ তাআলার আত্ন-মর্যাদাবোধে আঘাত করা হয়।

দুই. মুরাকাবার একটি বড় বিষয় হল, হারাম কথা ও কাজ থেকে সর্বদা দুরত্ব বজায় রাখা। সতর্কতা অবলম্বন করা।

6- عَنْ أبي هُريْرَةَ رضي اللَّه عنه أَنَّهُ سمِع النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم يَقُولُ : « إِنَّ ثَلاَثَةً مِنْ بَنِي إِسْرائيلَ : أَبْرَصَ ، وأَقْرَعَ ، وأَعْمَى ، أَرَادَ اللَّهُ أَنْ يَبْتَليَهُمْ فَبَعث إِلَيْهِمْ مَلَكاً ، فأَتَى الأَبْرَصَ فَقَالَ : أَيُّ شَيْءٍ أَحبُّ إِلَيْكَ ؟ قَالَ : لَوْنٌ حسنٌ، وَجِلْدٌ حَسَنٌ ، ويُذْهَبُ عنِّي الَّذي قَدْ قَذَرنِي النَّاسُ ، فَمَسَحهُ فذَهَب عنهُ قذرهُ وَأُعْطِيَ لَوْناً حَسناً . قَالَ : فَأَيُّ الْمالِ أَحَبُّ إِلَيْكَ ؟ قال : الإِبلُ     أَوْ قَالَ الْبَقَرُ     شَكَّ الرَّاوِي     فأُعْطِيَ نَاقَةً عُشرَاءَ ، فَقَالَ : بارَك اللَّهُ لَكَ فِيها .

فأَتَى الأَقْرعَ فَقَالَ : أَيُّ شَيْءٍ أَحب إِلَيْكَ ؟ قال : شَعْرٌ حسنٌ ، ويذْهبُ عنِّي هَذَا الَّذي قَذِرَني النَّاسُ ، فَمسحهُ عنْهُ . أُعْطِيَ شَعراً حسناً . قال فَأَيُّ الْمَالِ . أَحبُّ إِلَيْكَ ؟ قال : الْبَقرُ ، فأُعِطيَ بقرةً حامِلاً ، وقَالَ : بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِيهَا .

فَأَتَى الأَعْمَى فَقَالَ : أَيُّ شَيْءٍ أَحَبُّ إِلَيْكَ ؟ قال : أَنْ يرُدَّ اللَّهُ إِلَيَّ بَصَري فَأُبْصِرَ النَّاسَ فَمَسَحَهُ فَرَدَّ اللَّهُ إِلَيْهِ بصَرَهُ . قال : فَأَيُّ الْمَالِ أَحَبُّ إِليْكَ ؟ قال : الْغنمُ فَأُعْطِيَ شَاةً والِداً فَأَنْتجَ هذَانِ وَولَّدَ هَذا ، فكَانَ لِهَذَا وَادٍ مِنَ الإِبِلِ ، ولَهَذَا وَادٍ مِنَ الْبَقَرِ ، وَلَهَذَا وَادٍ مِنَ الْغَنَم .

ثُمَّ إِنَّهُ أتَى الأْبرص في صورَتِهِ وَهَيْئتِهِ ، فَقَالَ : رَجُلٌ مِسْكينٌ قدِ انقَطعتْ بِيَ الْحِبَالُ في سَفَرِي ، فَلا بَلاغَ لِيَ الْيَوْمَ إِلاَّ باللَّهِ ثُمَّ بِكَ ، أَسْأَلُكَ بِالَّذي أَعْطَاكَ اللَّوْنَ الْحَسَنَ ، والْجِلْدَ الْحَسَنَ ، والْمَالَ ، بَعيِراً أَتبلَّغُ بِهِ في سفَرِي ، فقالَ : الحقُوقُ كَثِيرةٌ . فقال : كَأَنِّي أَعْرفُكُ أَلَمْ تَكُنْ أَبْرصَ يَقْذُرُكَ النَّاسُ ، فَقيراً ، فَأَعْطَاكَ اللَّهُ ، فقالَ : إِنَّما وَرثْتُ هَذا المالَ كَابراً عَنْ كابِرٍ ، فقالَ : إِنْ كُنْتَ كَاذِباً فَصَيَّركَ اللَّهُ إِلى مَا كُنْتَ .

وأَتَى الأَقْرَع في صورتهِ وهيئَتِهِ ، فَقَالَ لَهُ مِـثْلَ ما قَالَ لهذَا ، وَرَدَّ عَلَيْه مِثْلَ مَاردَّ هَذَّا ، فَقَالَ : إِنْ كُنْتَ كَاذِباً فَصَيّرَكَ اللهُ إِليَ مَاكُنْتَ .

وأَتَى الأَعْمَى في صُورتِهِ وهَيْئَتِهِ ، فقالَ : رَجُلٌ مِسْكينٌ وابْنُ سَبِيلٍ انْقَطَعَتْ بِيَ الْحِبَالُ في سَفَرِي ، فَلا بَلاغَ لِيَ اليَوْمَ إِلاَّ بِاللَّهِ ثُمَّ بِكَ ، أَسْأَلُكَ بالَّذي رَدَّ عَلَيْكَ بصرَكَ شَاةً أَتَبَلَّغُ بِهَا في سَفَرِي ؟ فقالَ : قَدْ كُنْتُ أَعْمَى فَرَدَّ اللَّهُ إِلَيَّ بَصري ، فَخُذْ مَا شِئْتَ وَدعْ مَا شِئْتَ فَوَاللَّهِ ما أَجْهَدُكَ الْيَوْمَ بِشْيءٍ أَخَذْتَهُ للَّهِ عزَّ وجلَّ . فقالَ : أَمْسِكْ مالَكَ فَإِنَّمَا ابْتُلِيتُمْ فَقَدْ رضيَ اللَّهُ عنك ، وَسَخَطَ عَلَى صَاحِبَيْكَ » متفقٌ عليه .

হাদীস – ৬. আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেনঃ ‘‘বনী ইসরাইলের মধ্যে তিন ব্যক্তি ছিল ; কুষ্ঠরোগী, টাকমাথা ও অন্ধ। আল্লাহ তাদের পরীক্ষা করার ইচ্ছা করলেন। এ জন্য একজন ফেরেশতাকে তাদের কাছে পাঠালেন। সে কুষ্ঠরোগীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্ত কি? সে বলল, সুন্দর রং, সন্দর ত্বক এবং এ রোগ যেন আমার কাছ থেকে চলে যায়। যার কারণে লোকেরা আমাকে ঘৃণা করে। ফেরেশতা তার শরীর মুছে দিল। তাতে সে আরোগ্য লাভ করল এবং তাকে সুন্দর রঙ দান করা হল। তারপর ফেরেশতা জিজ্ঞস করল, কোন সম্পদ তোমার কাছে প্রিয়? সে বলল, উট। তাকে দশ মাসের গর্ভবতী একটি উট দেয়া হল। ফেরেশতা বলল, আল্লাহ এর মধ্যে তোমাকে বরকত দেবেন।

অতঃপর সে টাকমাথা ওয়ালা লোকটির কাছে যেয়ে বলল, তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিষ কী? সে বলল, সুন্দর চুল ও টাক রোগ থেকে আরোগ্য। যার কারণে লোকেরা আমাকে অপছন্দ করে। সে তার মাথা মুছে দিল। ফলে তার টাক চলে গেল। তাকে সুন্দর চুল দেয়া হল। সে জিজ্ঞেস করল, কোন সম্পদ তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। সে বলল, গরু। তখন তাকে একটি গর্ভবতী গাভী দান করা হল। ফেরেশতা বলল, আল্লাহ তোমাকে এতে বরকত দেবেন।

তারপর সে অন্ধলোকটির কাছে এসে জিজ্ঞস করল, তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্ত্ত কি? সে উত্তরে বলল, আল্লাহ আমার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিন, যাতে আমি লোকজনকে দেখতে পাই। সে তার চোখ মুছে দিল। এতে আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিলেন। সে জিজ্ঞেস করল, তোমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ কি? সে বলল, ছাগল। অতপর তাকে এমন একটি ছাগল দেয়া হল যা বেশী বাচ্চা দেয়। তারপর প্রত্যেকের উট, গাভী ও ছাগলের বাচ্চা হল। উট দিয়ে একটি মাঠ, গরু দিয়ে একটি মাঠ ও ছাগল দিয়ে একটি মাঠ ভরে গেল।

তারপর একদিন ফেরেশতা কুষ্ঠরোগীর কাছে আসল তার প্রথম আকৃতি ধারণ করে। এসে বলল, আমি একজন অসহায়। সফরে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আজ আল্লাহ সাহায্য ও তোমার দয়া ছাড়া আর এমন কোন উপায় নাই যার মাধ্যমে আমি আমার গন্তব্যে পৌছতে পারি। সেই আল্লাহর নামে আমি তোমার কাছে একটি উট চাচ্ছি যিনি তোমাকে সুন্দর রঙ, সুন্দর ত্বক, ও সম্পদ দিয়েছেন। সে বলল, আমার কাছে অনেকের পাওনা আছে। (তোমাকে কিছু দিতে পারব না) ফেরেশতা বলল, আমি বোধ হয় তোমাকে চিনি। তুমি কি কুষ্ঠরোগী ছিলে না? তোমাকে কি লোকে ঘৃণা করত না? তুমি কি নিঃস্ব ছিলে না? তোমাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন। সে বলল, আমি তো এ সম্পদ বংশানুক্রমে ওয়ারিস সুত্রে পেয়েছি। ফেরেশতা বলল, ‘তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাক তাহলে আল্লাহ তোমাকে যেন পূর্বের মত করে দেন।’

এরপর ফেরেশতা টাকওয়ালা ব্যক্তির কাছে আসল আগের আকৃতি ধারণ করে। এসে সেই কথাই বলল যা প্রথম ব্যক্তিকে বলেছিল। আর সে এমন উত্তরই দিল যা প্রথম ব্যক্তি দিয়েছিল। ফেরেশতা বলল, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাক তাহলে আল্লাহ তোমাকে যেন পূর্বের মত করে দেন।

তারপর ফেরেশতা অন্ধলোকটির কাছে আসল। এসে বলল, আমি একজন অসহায় মুসাফির। আমার সব পাথেয় সফরে শেষ হয়ে গেছে। এখন গন্তব্যে যেতে আল্লাহর সাহায্য ও তোমার দয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। তাই তোমার কাছে সেই আল্লাহর নামে একটি ছাগল চাচ্ছি, যিনি তোমাকে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। লোকটি বলল, আমি অন্ধ ছিলাম আল্লাহ আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। অতএব তোমার যত ইচ্ছা সম্পদ নিয়ে যাও। আর যা ইচ্ছা রেখে যাও। আল্লাহর কসম! আজ তুমি আল্লাহ তাআলার নামে যা কিছু নেবে আমি তাতে বাধা দেব না।

ফেরেশতা বলল, ‘‘তোমার সম্পদ তোমার কাছেই থাক। তোমাদের শুধু পরীক্ষা করা হয়েছে। আল্লাহ তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং অপর দুজনের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন।’’

বর্ণনায়ঃ বুখারী ও মুসলিম

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ

এক. পূর্বেকার লোকদের ইতিহাস আলোচনা করা ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি সুন্নত বা আদর্শ।

দুই. এ ঘটনায় আলোচিত তিন ব্যক্তির মধ্যে দু জনই তাদের ইতিহাস ভুলে গিয়েছিল। ফলে তারা পূর্বের দুরাবস্থায় ফিরে গেছে।

তিন. আমি আগে কী ছিলাম? এখন কী হয়েছি? তাই আমার কী করা উচিত? এগুলো চিন্তা করে কাজ করা হল একটি মুরাকাবা। বিষয় শিরোনামের সাথে এখানে হাদীসটির সম্পর্ক।

চার. কেহ আল্লাহর নামে সাহায্য চাইলে তাকে সাহায্য করতে হয়। ফিরিয়ে দেয়া উচিত নয়।

পাঁচ. মানুষ সম্পদশালী হয়ে অহংকারী হয়ে যায়, ফলে সে নিজের অতীত ইতিহাস ও তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ভুলে যায়। অতীতে তার অবস্থা করুণ ছিল এটা অনেকে স্বীকার করতে চায় না। এটা মানুষের একটি খারাপ স্বভাব। হাদীসে বর্ণিত ঘটনা আমাদের সে কথার দিক ইঙ্গিত করে। আর কে এ স্বভাব ত্যাগ করতে পারে, আর কে পারে না এটা পরীক্ষার জন্য আল্লাহ অনেক সময় মানুষকে সম্পদ দান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

‘‘অতঃপর কোন বিপদাপদ মানুষকে স্পর্শ করলে সে আমাকে ডাকে। তারপর যখন আমি আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দিয়ে তাকে অনুগ্রহ করি তখন সে বলে, ‘জ্ঞানের কারণেই কেবল আমাকে তা দেয়া হয়েছে’। বরং এটা এক পরীক্ষা। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।’’ সূরা যুমার, আয়াত ৪৯

ছয়. আল্লাহর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় না করা নেয়ামত চলে যাওয়ার একটি কারণ। কুষ্ঠরোগী ও টাকওয়ালা আল্লাহর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের নেয়ামত নিয়ে গেছেন।

সাত. আল্লাহ যেমন মানুষকে রোগ, শোক, দুঃখ কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন তেমনি সুস্বাস্থ্য, সম্পদ, সুখ্যাতি, ক্ষমতা দিয়েও পরীক্ষা করে থাকেন।

আট. আল্লাহ তাআলার শোকরিয়া আদায় করে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যেমন আমরা দেখলাম, এই তিন জনের মধ্যে দুজনই আল্লাহর নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করতে পারল না। আল্লাহ নিজেও বলেন

اعْمَلُوا آَلَ دَاوُودَ شُكْرًا وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ

‘‘হে দাউদ পরিবার! তোমরা আমার শোকরিয়া স্বরূপ আমল করে যাও এবং আমার বান্দাদের মধ্যে শোকরিয়া আদায়কারী খুব কম।’’

সূরা সাবা, আয়াত ১৩

নয়. এ হাদীসে ছদকার ফজিলত ও কৃপণতার শাস্তির বিষয়টি আমরা দেখতে পেলাম।

দশ. অসহায় মানুষের প্রতি দয়া করা একান্ত কর্তব্য।

7- عَنْ أبي يَعْلَى شَدَّادِ بْن أَوْسٍ رضي اللَّه عنه عن النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم قال : «الكَيِّس مَنْ دَانَ نَفْسَهُ ، وَعَمِلَ لِما بَعْدَ الْموْتِ ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَه هَواهَا ، وتمَنَّى عَلَى اللَّهِ الأماني » رواه التِّرْمِذيُّ وقالَ  حديثٌ حَسَنٌ

হাদীস – ৭. আবু ইয়ালা শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘বুদ্ধিমান তো সেই ব্যক্তি যে নিজের হিসাব নিজে করে নেয় এবং মৃত্যু পরবর্তী সময়ের জন্য কাজ করে। আর নির্বোধ ঐ ব্যক্তি যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, আবার আল্লাহর কাছে বিভিন্ন রকম আশা-প্রত্যাশা করে।’’ বর্ণনায়ঃ তিরমিজী, তিনি বলেছেন হাদীসটি হাসান।

বিশেষ জ্ঞাতব্যঃ হাদীসটি সনদ-সুত্রের বিশুদ্ধতার বিবেচনায় একটি দুর্বল হাদীস।

8- عَنْ أبي هُرَيْرَةَ رضي اللَّهُ عنهُ قال : قالَ رسولُ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم : مِنْ حُسْنِ إِسْلامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَالاَ يَعْنِيهِ » حديثٌ حسنٌ رواهُ التِّرْمذيُّ وغيرُهُ .

হাদীস – ৮. আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘মানুষের ইসলামের সৌন্দয্য ও উৎকর্ষতার একটি দিক হল, অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা।’’

বর্ণনায়ঃ তিরমিজী ও অন্যান্য ইমামগণ

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েলঃ

এক. এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীস। এমন সকল কথা ও কাজ পরিহার করতে হবে, যা দ্বারা কেহ কোন লাভবান হয় না।

দুই. ইসলামের সৌন্দর্যের অনেকগুলো বিষয় আছে, যার গুরুত্বপূর্ণ একটি হল অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা।

তিন. অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা মুরাকাবা বা আত্নপর্যালোচনার একটি উপায়। যদি প্রতিটি কাজ ও কথা বলার পূর্বে চিন্তা করা হয়, আমাদের জন্য এটি কতখানি উপকারী হবে, তাহলে কল্যাণকর কাজ করা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।

চার. যে সকল মুমিন অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করে চলে আল্লাহ তাআলা সূরা আল-মুমিনূনের তিন নং আয়াতে তাদের প্রশংসা করেছেন। বলেছেনঃ

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ

‘‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিমুখ।’’ (তাদের জন্য জান্নাত)

9- عَنْ عُمَرَ رضي اللَّهُ عنه عَنِ النَّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم قال : « لا يُسْأَلُ الرَّجُلُ فيمَ ضَربَ امْرَأَتَهُ » رواه أبو داود وغيرُه .

হাদীস – ৯. উমার রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি নিজ স্ত্রীকে মেরেছে তাকে প্রশ্ন করা হবে না কেন সে মেরেছে।’’ বর্ণনায়ঃ আবু দাউদ

বিশেষ জ্ঞাতব্যঃ সুত্র ও অর্থ উভয় দিকে দিয়ে এটি একটি অতি দুর্বল হাদীস। এটির উপর নির্ভর করে আমল করা যায় না।

হাদীসগুলো ইমাম নববী রহ. এর রিয়াদুস সালেহীন থেকে নেয়া।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan