মৃত ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসিন পাঠ করার বিধান

আমাদের সমাজে সূরা ইয়াসীনের অনেক ফাযীলত বর্ণিত আছে । বিভিন্ন কিতাবে, ওয়াজ মাহফিলে বক্তারা সূরা ইয়াসীনের অনেক অনেক ফাযীলত বর্ণনা করে থাকেন। অথচ সূরা ইয়াসীন সম্পর্কে পৃথকভাবে ফাযীলত বর্ণনা করে আমলযোগ্য কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি।

নিচে সূরা ইয়াসীন সম্পর্কে বর্ণিত কতিপয় বানোয়াট ও দুর্বল হাদীস উল্লেখ করা হল। যেগুলোকে ক্ষমা পাওয়ার সহজ মাধ্যম মনে করে সাধারণ মানুষ সহজেই গ্রহণ করে থাকেন।

মৃতের নিকট সূরা ইয়াসিন পাঠ সম্পর্কিত যইফ হাদীসসমূহ

১। একটি বানোয়াট কথিত হাদীসের মধ্যে এসেছেঃ “ যে ব্যক্তি কবরস্থানে প্রবেশ করে সেখানে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে সেদিন তাঁদের (কবরবাসীর) আযাব হালকা করা হবে এবং সেখানে যারা রয়েছে তাদের সংখ্যায় সে ব্যক্তির (পাঠকারীর) জন্য সাওয়াব লিখা হবে।” [কিন্তু এটি বানোয়াট, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্ধৃতিতে জাল করা হয়েছে।] (দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, হা/ ১২৪৬)

২। অন্য এক বানোয়াট হাদীসের মধ্যে এসেছেঃ “কোন ব্যক্তি মারা গেলে আর তাঁর নিকটে সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হলে আল্লাহ্‌ তা’আলা সহজ করে দেন।” [কিন্তু হাদীসটি বানোয়াট, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে।] (দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, হা/ ৫২২১), য’ঈফুত তারগীব অত-তারহীব, হা/ ৪৫০)

৩। “যে ব্যক্তি জুম’আর রাতে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (এ হাদীস খুবই দুর্বল, য’ঈফ জিদ্দান, দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, হা/ ৫১১২ )

৪। “যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাঁর দ্বারা আল্লাহকে পাওয়ার আশায়, আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং সে যেন বারোবার কুরআন পাঠ করেছে তাকে তাঁর সাওয়াব দান করবেন। আর যে রোগীর নিকটেই সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হবে তাঁর নিকট প্রত্যেক অক্ষরের সংখ্যায় দশজন করে ফেরেশতা নেমে আসবে যারা তাঁর সামনে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়াবে। অতঃপর তাঁর জন্য রহমাত কামনা করবে, তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তাঁরা তাঁর আত্মা কবয করা ও গোসল দেওয়ার সময় উপস্থিত থাকবে, তাঁর জানাযার (কফিনের) অনুসরণ করবে, তাঁর সলাত আদায় করবে এবং তাঁর দাফনের সময়ও উপস্থিত থাকবে। আর যে রোগী সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মৃত্যুর যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে তাঁর আত্মা সে সময় পর্যন্ত মালাকুত মওত কবয করবে না যে পর্যন্ত জান্নাতের পাহারাদার রিযওয়ান জান্নাতী শরবত নিয়ে উপস্থিত না হবে। অতঃপর সে তাঁর বিছানায় থাকা অবস্থায় পান করবে, এরপর তাঁর মৃত্যু হবে। সে পরিতৃপ্ত অবস্থাতেই থাকবে। সে নাবীগণের কোন হাউযের (পানির) মুখাপেক্ষী হবে না। জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে পরিতৃপ্তই থাকবে।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, হা/ ৪৬৩৬)

৫। “সূরা ইয়াসীনকে তাওরাতের মধ্যে আল-মু‘ইম্মা নামে ডাকা হত। কারণ তা দুনিয়া এবং আখেরাতের কল্যাণকে পাঠকারীর জন্য সম্পৃক্ত করেছে। তা তাঁর থেকে দুনিয়ার বিপদাপদকে দূরে রাখে এবং আখেরাতের বিভীষিকাকে প্রতিহত করে।” (হাদীসটি খুবই দুর্বল, দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, হা/ ৩২৬০)

৬। “যে ব্যক্তি জুম’আর দিনে তাঁর পিতা-মাতার কবর যিয়ারাত করে তাদের দু’জনের নিকট অথবা একজনের নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাকে প্রত্যেক আয়াত অথবা অক্ষরের সংখ্যার বিনিময়ে ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, হা/৫০)

৭। “তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের উপর সূরা ইয়াসীন পাঠ কর।” (হাদীসটি দুর্বল, মিশকাত ১৬২২, য’ঈফ আবী দাউদ ৩১২১, ইরওয়াউল গালীল ৬৮৮, য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ১০৭২ ও য’ঈফুত তারগীব অত-তারহীব ৮৮৪ )

৮। “প্রতি বস্তুরই অন্তর থাকে আর কুরআনের অন্তর হচ্ছে সূরা ইয়াসীন, যে ব্যক্তি একবার সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে, এ পাঠের দ্বারা আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁর জন্য দশবার কুরআন পাঠ করার সমান সাওয়াব লিখে দিবেন।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ১৯৩৫, য’ঈফ তিরমিযী ২৮৮৭)

৯। “তুমি তোমার তর্জনী আঙ্গুলি তোমার মাড়ির দাতের উপরে রেখে সূরা ইয়াসীনের শেষাংশ পাঠ কর। আ-অ-লাম ইয়ারাল ইনসানু আন্না খলাকনাহু মিন নুতফাতিন…।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৩৫৮৭, সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, ৩৮১৪ )

১০। “যে ব্যক্তি জুম’আর দিনে তাঁর পিতা-মাতার অথবা দু’জনের একজনের কবর যিয়ারাত করবে অতঃপর তাঁর নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৫৬০৬)

১১। “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাঁর পূর্ববর্তী যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, অতএব তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসীন পাঠ কর। ” (হাদীসটি দুর্বল, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৫৭৮৫)

১২। “যে ব্যক্তি একবার সূরা ইয়াসীন পাঠ করল সে যেন দশবার কুরআন পাঠ করল।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৫৭৮৬)

১৩। “যে ব্যক্তি রাতে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে এ অবস্থায় সে সকাল করবে।” (হাদীসটি দুর্বল, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৫৭৮৭)

১৪। “যে ব্যক্তি রাতে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (হাদীসটি দুর্বল, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৫৭৮৮)

১৫। “যে ব্যক্তি একবার সূরা ইয়াসীন পাঠ করল সে যেন দু’বার কুরআন পাঠ করল।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৫৭৮৯)

১৬। “জুম’আর রাতে চার রাক’আত সলাত আদায় এবং তাঁর প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহার পরে সূরা ইয়াসীন পাঠ করা…… মর্মে যে দীর্ঘ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এবং তাশাহুদের পরে দীর্ঘ দু’আ উল্লেখ করে যে ফাযীলত বর্ণনা করা হয়েছে সে হাদীসটি বানোয়াট।” (য’ঈফ তিরমিযী ৩৫৭০)

১৭। “যে ব্যক্তি সকাল বেলা সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে, তাঁর সকল প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ করে দেওয়া হবে।” ( হাদীসটি মুরসাল হিসেবে আতা ইবনু আবী রাবাহ হতে বর্ণিত হয়েছে। দারেমী বর্ণনা করেছেন, কিন্তু সহীহ নয়। )

১৮। “কুরআনের অন্তর হচ্ছে সূরা ইয়াসীন, যে ব্যক্তিই আল্লাহ্‌ এবং আখেরাতকে লাভের আশায় তা পাঠ করবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। অতএব তোমরা মৃত ব্যক্তির নামে কুরআন পাঠ কর।” (হাদীসটি দুর্বল, দেখুন য’ঈফ জামে’ইস সাগীর ৮৮৪)

১৯। “যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন পাঠ করে তা পান করবে, তার পেটে এক হাজার নূর, এক হাজার রহমাত, এক হাজার বরকত, এক হাজার ঔষধ প্রবেশ করবে অথবা তাঁর থেকে এক হাজার রোগ বেরিয়ে যাবে।” (হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, ৩২৯৩ )

২০। এক কথিত হাদীসের মধ্যে এসেছে , যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন শ্রবণ করবে তা তাঁর জন্য বিশ দিনার আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার সমান হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তা তাঁর জন্য বিশটি হজ্ব আদায়ের সমান হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি লিখবে এবং তাকে পান করাবে তাঁর পেটে এক হাজার ইয়াকীন, এক হাজার নূর, এক হাজার বরকত, এক হাজার রহমাত, এবং এক হাজার রিযকের অনুপ্রবেশ ঘটানো হবে এবং তাঁর থেকে সকল প্রকার ঈর্ষা বের করে নেওয়া হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে তাঁর থেকে সকল প্রকার রোগ বের করে নেওয়া হবে। (হাদীসটি বানোয়াট, আল্লামা শাওকানী “আল-ফাওয়াইদুল মাজমু’আহ” গ্রন্থে (১/৩০০) বলেনঃ হাদীসটি খাতীব বাগদাদী আলী সূত্রে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু হাদীসটি বানোয়াট। ইবনু আদী বলেনঃ এ হাদীসটি জাল করার ব্যাপারে আহমাদ ইবনু হারুন অভিযুক্ত।)

২১। আরেকটি কথিত হাদীসের মদ্ধ্যে এসেছেঃ আবূ ক্বিলাবাহ বলেনঃ যে ব্যকি সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে পথভ্রষ্ট থাকা অবস্থায় সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে সে হিদায়াত লাভ করবে। যে ব্যক্তি তাঁর কিছু হারিয়ে যাওয়ার কারণে সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে সে তা পেয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সেই খাদ্যের নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে যে খাদ্য কম বলে ভয় করছিল তা তাঁর জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির নিকট পাঠ করবে তাঁর জন্য সহজ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি সন্তান প্রসবের সময় কষ্টে থাকা মহিলার নিকট পাঠ করবে তাঁর জন্য সন্তান প্রসব সহজ করে দেওয়া হবে। আর যে একবার সূরা ইয়াসীন পাঠ করল সে যেন এগারো বার কুরআন পাঠ করল। আর প্রত্যেক বস্তুর হৃদয় রয়েছে কুরআনের হৃদয় হচ্ছে সূরা ইয়াসীন। (“কাশফুল খাফা” গ্রন্থে এটি বাইহাক্বীর বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটি বানোয়াট, দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ, ৩২৯৩)

এছাড়া মৃত ব্যক্তি বা তাঁর কবরের নিকট সূরা বাক্বারার প্রথম ও শেষ আয়াতগুলো পাঠ করা মর্মে যে আসার বর্ণিত হয়েছে তা সহীহ নয়। আনসারদের উদ্ধৃতিতে মৃত ব্যক্তির নিকট কুরআন পাঠ করা মর্মে যা কিছু বর্ণনা করা হয়ে থাকে সেগুলোও সহীহ নয়।

অতএব বানোয়াট এবং দুর্বল হাদীস নির্ভর সূরা ইয়াসীনের ফাযীলাতগুলো থেকে বিরত থাকাই হবে প্রকৃত জ্ঞানের পরিচায়ক।

এছাড়া যে বলা হয়েছে। “ কোন ব্যক্তি কবরস্থান অতিক্রম করার সময় ‘কুল হু আল্লাহু আহাদ’ সূরা এগারো বার পাঠ করে। তাঁর সাওয়াব যদি মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে হেবাহ করে দেয় তাহলে তাকে মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যায় সাওয়াব দেওয়া হবে।”

এ হাদীসটি বাতিল ও বানোয়াট। এটিকে আবূ মুহাম্মাদ আল-খাল্লাল “আল -কিরাআতু আলাল কুবুর”(কাফ ২০১/২) গ্রন্থে এবং দাইলামী “আব্দুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনু ‘আমের কর্তৃক তাঁর পিতা হতে বর্ণনাকৃত… কপিতে ” বর্ণনা করেছেন। এ পাণ্ডুলিপিটি বানোয়াট ও বাতিল। এটিকে হয় আব্দুল্লাহ অথবা তাঁর পিতা বানিয়েছেন। যেমনটি হাফেয যাহাবী “আল-মীযান” গ্রন্থে বলেছেন আর ইবনু হাজার “আল-লিসান” গ্রন্থে তাঁর অনুসরণ করেছেন। এছাড়া সুয়ূতী “যায়লুল আহাদীসিল মওযূ’আহ” গ্রন্থে এবং ইবনু আররাক “তানযীহুশ শারী’আহ…।” গ্রন্থে [জাল হওয়ার ব্যাপারে] তাঁর অনুসরণ করেছেন। এর পরেও সুয়ূতী সম্ভবত ভুলে গিয়ে “শারহুস সদূর” গ্রন্থে (১৩০) উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে শুধুমাত্র দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর দুর্বল বলাটা যথেষ্ট নয়, কারণ হাদীসটি বানোয়াট। (বিস্তারিত দেখুন সিলসিলা য’ঈফাহ অল-মওযূআহ ১২৯০ )

মোটকথা কবরের নিকট বা মৃত ব্যক্তির নিকট কুরআন তিলাওয়াত সংক্রান্ত বিষয়ে সহীহ সূত্রে কোন হাদীসই বর্ণিত হয়নি।

সূত্রঃ মৃত্যুরোগ থেকে শুরু করে মৃতব্যক্তি কেন্দ্রীক যাবতীয় করনীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহ,

লেখকঃ আবূ শিফা মুহাম্মাদ আকমাল হুসাইন।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88