হিজরি নববর্ষ উপলক্ষে অভিনন্দন বিনিময়ের বিধান
আল্হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু ‘আলা খাতামিল আম্বিয়াই ওয়াল-মুরসারীন।
সকল প্রশংসা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার জন্যে। সালাত ও সালাম শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।
অভিনন্দন বিনিময়ের কিছু উপলক্ষ :
১. পারস্পরিক স্বাভাবিক অভিনন্দন। যা একে অপরকে নতুন কোন নিয়ামত অর্জন বা মুসিবত থেকে মুক্তির প্রাক্কালে দিয়ে থাকে। উদ্দেশ্য আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন এবং একজন মুসলিম ভাইকে আনন্দিত ও উৎসাহিত করা। এটা কোন দিনক্ষণ বা মাস, বৎসরের আগমন-প্রস্থানের সাথে সম্পৃক্ত নয়। যেমন, বিবাহ, নতুন সন্তান লাভ, পরীক্ষায় কৃতকার্য, চাকুরি লাভ করা ইত্যাদি উপলক্ষে অভিনন্দন প্রদান।
এরূপ অভিনন্দন আদান-প্রদানে শরীর কোন সমস্যা নেই এটি একটি মানবিক স্বভাবগত বিষয়, বরং আশা করা যায় এতে অভিনন্দন প্রদানকারী ছাওয়াব পাবেন। কারণ তিনি একজন মুসলিম ভাইকে প্রফুল্ল করলেন। আনন্দিত করলেন। যাতে সে উৎসাহ বোধ করবে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. এর মতে। মুবাহ কাজ ভাল নিয়তে সম্পর্কিত হলে কল্যাণ মূলক কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়। আর মন্দ নিয়তে সম্পাদন করলে মন্দ কর্মের ভিতর গণ্য হয়।
২. নির্দিষ্ট সময় যেমন ঈদ, বৎসর, মাস, দিন উপলক্ষে অভিনন্দন আদান-প্রদান এর বিধান সম্পর্কে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ঈদ-ঈদুল আযহা, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে অভিনন্দন প্রসঙ্গে নতুন করে বলার কিছু নেই। এটি জায়েয মর্মে মোটামুটি সকলের নিকটই পরিষ্কার। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহাবিদের আমলদ্বারা প্রমাণিত। নববর্ষ : যেমন হিজরি নববর্ষ উপলক্ষে অভিনন্দন। মাস : যেমন রমজান মাস উপলক্ষে অভিনন্দন। এর একটি ভিত্তি আছে এবং এ প্রসঙ্গে মতানৈক্যের দিকটিও সকলের নিকট প্রসিদ্ধ।
আর বিভিন্ন দিবস যেমন নবিজির জন্ম দিবস, ইসরা, মি’রাজ দিবস ইত্যাদি উপলক্ষে অভিনন্দন বিনিময়। এর বিধান স্পষ্ট-সকলেই জানে- অর্থাৎ বিদয়াত। কারণ বিদয়াত পন্থীদের রীতি-নীতির সাথে এর একটি সূত্রিতা রয়েছে। প্রথমটি ব্যতীত বর্ণিত অভিনন্দন সমূহের কোনটি সম্পর্কেই নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবিদের কারো থেকে কোন প্রমাণ নেই। অথচ তাঁদের যুগে এ উপলক্ষে ও কার্য কারণগুলো বিদ্যমান ছিল এবং অভিনন্দন প্রচলনের কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তা সত্ত্বেও তাঁরা তা করেন নি, না নবিজি নিজে না তাঁর কোন সাহাবি। বরং তাঁরা অভিনন্দন বিনিময়কে শুধুমাত্র দুই ঈদ পর্যন্ত সীমিত রেখেছেন।
• বিজ্ঞ ঊলামায়ে কেরাম থেকে নববর্ষের শুরুতে পারস্পরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের বিধান সম্পর্কে দু’ধরনের মত পাওয়া যায়।
এক. বৈধ এবং এটি মানুষের স্বভাবগত একটি বিষয়। প্রখ্যাত মনীষী শায়খ মুহাম্মদ বিন উসাইমীন র. ও এ মতের সমর্থক। তিনি বলেছেন।
আমার মতে নববর্ষের শুরুতে অভিনন্দন ও মোবারক বাদ প্রদানে শরীয়ী কোন সমস্যা নেই। তবে বিষয়টি (পূর্ব থেকে) অনুমোদিত এমন নয়। একথার অর্থ হচ্ছে আমরা লোকদের এরূপ বলব না যে, এ উপলক্ষে তোমাদের একে অপরকে অভিনন্দন জানানো সুন্নত। তবে হ্যাঁ তারা যদি এরূপ করে তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই। এখন যদি কেউ কাউকে অভিনন্দন করে তাহলে তার উপচিত হবে তাঁর জন্যে আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করা যে এ বৎসরটি যেন তার জন্যে কল্যাণ ও বরকতের বৎসর হয়। আর মানুষ অভিনন্দন কামনা করে। এ মাস আলা সম্পর্কে আমি এতটুকুই জানি এবং আমার অভিমত ও তাই। অভিনন্দন মানুষের স্বভাবগত ব্যাপার, কোন ইবাদত সম্পর্কীয় বিষয় নয়।
لقاء الباب المفتوح (লিকাউল বাবিল মাফতুহ)
এ বিষয়ে শায়খ র. এর আরো বক্তব্য আছে (اللقاء الشهري/ লিকায়ে শাহরী/ মাসিক সাক্ষাতকারে) তিনি বলেছেন : যদি কেউ তোমাকে অভিনন্দন-মুবারকবাদ জানায় তাহলে তুমিও তাকে অভিনন্দিত করবে। কিন্তু তুমি আরম্ভ করবে না। এবং প্রথমে কাউকে অভিনন্দন জানাবে না। এ মাসআলাতে এটিই সঠিক।
যদি তোমাকে কেউ বলে, নববর্ষ উপলক্ষে তোমাকে অভিনন্দন বা শুভ নববর্ষ ইত্যাদি তাহলে উত্তরে তুমি বলবে। আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য কল্যাণ করুন। এ বৎসরকে তোমার জন্যে কল্যাণ ও বরকতময় করুন। কিন্তু তুমি প্রথমে লোকদের অভিনন্দন দেয়া শুরু করবে না। কারণ সালাফে সালেহীনদের কেউ এরূপ অভিনন্দন আদান-প্রদান করেছেন বলে আমার জানা নেই। বরং সকলের জানা থাকা ভাল, যে পূর্ববর্তী মনীষীগণ মহররম কে বৎসরের শুরু হিসাবে ওমর রা. এর খেলাফত কাল থেকে গণ্য করা শুরু করেছেন।
আল-জিয়াউল লামে’য়/ الضياء اللامع গ্রন্থের ৭০২ পৃষ্ঠায় বলেছেন
নববর্ষের আগমন উপলক্ষে উৎসব করা বা অভিনন্দন বিনিময়ের প্রচলন ঘটানো সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেউ কেউ এ অভিনন্দন বিনিময় কর্মকে যারা বৈধ বলে মত দিয়েছেন তাদের মধ্যে শাফেয়ি মাজহাবের মুতাআখখিরীনদের মধ্য হতে ইমাম কামভেলী /القمولى এবং ইমাম সুয়ূতী আর হাম্বলীদের মধ্য হতে ইমাম আবুল হাসান মাকদেসীর নাম উল্লেখ করেছেন। কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় আমি এর বিস্তারিত বর্ণনায় গেলাম না।
দুই. এটি একেবারেই নিষিদ্ধ আর এ মতটিই হচ্ছে অগ্রাধিকার যোগ্য মত। যারা এ মতামত ব্যক্ত করেছে তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন সুনান খ্যাত গবেষক শায়খ সালেহ আল ফাউযান। নববর্ষ উপলক্ষে অভিনন্দন বিনিময় সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেছেন : এ কর্মের কোন শরয়ী ভিত্তি আছে বলে আমাদের জানা নেই। হিজরি তারিখের প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও এ ছিল না যে, শুরু বর্ষকে লোকেরা এটি উপলক্ষ বানাবে। একে অপরকে অভিনন্দন জানাবে। বিভিন্ন উপায়ে উদযাপন করবে, উৎসব করবে, আলোচনা করবে। বরং হিজরি বৎসর ও তারিখ প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল تميز العقود তথা বিভিন্ন দাপ্তারিক কাজে শৃঙ্খলা রক্ষার্থে চুক্তি ও সম্পাদন যোগ্য বিষয়াবলীর একটি থেকে অপরটিকে পৃথক করে সামঞ্জস্য বিধান। যেমনটি করেছিলেন হযরত ওমর রা. তাঁর রাজত্বকালে যখন ইসলামি খেলাফতের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়ে গিয়ে ছিল, তাঁর নিকট বিভিন্ন স্টেট থেকে সময় তারিখ উল্লেখ বিহীন অনেক চিঠিপত্র আসতে লাগল, তখন প্রত্যেক চিঠিকে আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা এবং লেখার তারিখ ও সময় সম্পর্কে অবহিত হয়ে কাজে শৃঙ্খলা ও গত আনার জন্যে চিঠিতে তারিখ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ওমর রা. সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করলেন সাহাবারা হিজরতের বৎসরকে হিজরি তারিখের সূচনা করে নতুন গণনা শুরু করার পরামর্শ দিলেন এবং তৎকালীন বিদ্যমান থাকা মীলাদী (ঈসায়ী) তারিখকে বাদ দিয়ে হিজরতকে প্রথম ধরে হিজরি সনের প্রবর্তন করলেন। যাতে যুক্তি ও লেখার সময় জানা থাকে এবং কাজ সুশৃঙ্খল ও গতিশীল হয়। এটিই ছিল হিজরি সন প্রবর্তনের মূল কারণ। এটিকে একটি উপলক্ষ বানিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসব উদযাপন করে বিদয়াতের রাস্তা ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে এর প্রবর্তন হয়নি।