দল, ইমারত ও বায়আত সম্পর্কে উলামাগণের বক্তব্য (পর্ব ১)
দল, সংগঠন, ইমারত ও বায়‘আত সম্পর্কে বিশিষ্ট উলামায়ে কেরামের বক্তব্য (প্রথম পর্ব)
অনুবাদ : আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
অনুবাদকের কথা
যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহ্র জন্য, যিনি গোটা মুমিন সম্প্রদায়কে পরস্পরের ভাই হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর উপর, যিনি গোটা মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন।
ইসলাম মুসলিমদেরকে এমন অটুট বাঁধনে বেঁধেছে, কোনো দল, জামা‘আত বা সংগঠনের পক্ষে কখনই তার ধারেকাছে যাওয়াও সম্ভব নয়। ইসলামে ইসলামী ভ্রাতৃত্বই মিত্রতা ও শত্রুতা পোষণের মানদণ্ড। চিনুক বা না চিনুক একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِخۡوَةٞ فَأَصۡلِحُواْ بَيۡنَ أَخَوَيۡكُمۡۚ ﴾ [الحجرات: ١٠]
‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও’ (আল-হুজুরাত ১০)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পারস্পরিক ভালবাসা, দয়ার্দ্রতা এবং সহানুভূতিশীলতার ক্ষেত্রে গোটা মুমিন সম্প্রদায় একটি দেহের মত। দেহের একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে তার জন্য পুরো দেহ ব্যথা অনুভব করে’ (মুসলিম, হা/২৫৮৬)।
তিনি অন্যত্র বলেন, ‘মুমিনরা নির্মিত ভবনের মত, যার একাংশ অন্য অংশের সাথে শক্তভাবে গাঁথা’ (বুখারী, হা/৬০২৬)।
এমনকি একজন মুসলিম যদি পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে এবং অপরজন পশ্চিম পান্তে থাকে, তথাপিও তারা পরস্পর বন্ধু। সুফিয়ান ছাওরী বলেন, ‘পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থানকারী আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের দু’জন ব্যক্তির সংবাদ যদি তোমার কাছে পৌঁছে, তাহলে তাদের উভয়ের নিকট তুমি সালাম পাঠাও এবং তাদের জন্য দো‘আ কর। আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের লোকদের সংখ্যা কতই না কম!’([১]) এই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ্র পরস্পরের মধ্যে গভীর সম্পর্কের ইলাহী ব্যবস্থাপনা।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত না হয়ে একতাবদ্ধভাবে থাকতে বলেছেন এবং একতাবদ্ধ হওয়ার মানদণ্ডও বাৎলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ ﴾ [ال عمران: ١٠٣]
‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ১০৩)।
উক্ত আয়াতে একতাবদ্ধ হওয়ার মানদণ্ড হিসাবে আল্লাহ্র রজ্জু তথা কুরআন ও হাদীছের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সঠিক আক্বীদার বাইরে গিয়ে একতাবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ দলাদলি ও বিভক্তির নিন্দা করে বলেন,
﴿ وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُواْ وَٱخۡتَلَفُواْ مِنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلۡبَيِّنَٰتُۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٥ ﴾ [ال عمران: ١٠٥]
‘আর তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং বিরোধ করেছে। আর তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি’ (আলে ইমরান ১০৫)।
অন্য আয়াতে এসেছে,
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمۡ وَكَانُواْ شِيَعٗا لَّسۡتَ مِنۡهُمۡ فِي شَيۡءٍۚ ﴾ [الانعام: ١٥٩]
‘নিশ্চয়ই যারা নিজেদের ধর্মকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই’ (আল–আন‘আম ১৫৯)।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ আজ শতধাবিভক্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে। আমরা মুসলিম উম্মাহ বলতে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে বুঝাচ্ছি। কারণ এই লেখায় আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের বাইরের ভ্রান্ত ফেরক্বাগুলি আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই, আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত বিভিন্ন সময় এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছে। যেমন, আত-ত্বয়েফাহ আল-মানছূরাহ, আল-ফেরক্বাহ আন-নাজিয়াহ, আহলুল হাদীছ, আছহাবুল হাদীছ, আহলুল আছার, সুন্নী ইত্যাদি। এই ব্যাপক অর্থে প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের প্রকৃত অনুসারীদের উপরও এসব নাম প্রযোজ্য হবে। তবে প্রসিদ্ধ চার ইমামের কোনো একজনের অনুসারী যদি তার ইমামের আক্বীদা গ্রহণ না করে ভ্রান্ত ভিন্ন কোনো আক্বীদা গ্রহণ করে, তাহলে সে তার দায়িত্ব বহন করবে। অনুরূপভাবে এসব নামে গঠিত কোনো সংগঠন যদি কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃস্বার্থ অনুসারী হয়ে থাকে, তাহলে তারাও আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে। তবে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত বলতে কস্মিনকালেও নির্দিষ্ট কোনো দল, মাযহাব বা জামা‘আতকে বুঝাবে না। কেউ কুরআন-হাদীছ ও সালাফে ছালেহীনের মূলনীতি থেকে সরে গেলে সে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে না; সে যে যুগের, যে দেশের, যে মাযহাবের বা যে দলেরই হোক না কেন। অনুরূপভাবে কোনো দল যদি নিজেদেরকে ‘আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’ নামে নামকরণ করে হরহামেশা আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নীতি বিরোধী কাজ করে এবং নানামুখী শির্ক-বিদ‘আতই তাদের সাধনা হয়, তাহলে এই নামকরণ তাদের বিন্দুমাত্র উপকারে আসবে না; বরং তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।
উল্লেখ্য যে, নিজেদেরকে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত দাবী করা সত্ত্বেও উপরিউক্ত নামগুলির প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ করা, সেগুলো সম্পর্কে বিষোদগার করা এবং নিজেদের ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রয়োগকে অস্বীকার করা যেমন মহা অন্যায়; তেমনি সেগুলোকে গুটিকয়েক মানুষ নিয়ে গঠিত কোনো দল, মাযহাব বা জামা‘আতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অপচেষ্টাও কম অন্যায় নয়। মূলতঃ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী এই দুই পক্ষ উল্লেখিত পরিভাষাগুলো অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে। আর তা না হলে কোনো হীন স্বার্থে তারা সেগুলো না বুঝার ভান করেছে।
হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীছে ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ বলতে আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে বুঝানো হয়েছে। আরেক অর্থে, গোটা মুসলিম উম্মাহ যখন একজন খলীফার হাতে বায়‘আত করবে, তখন তাদেরকেও ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ বলা হবে এবং তাদের বায়‘আতকৃত খলীফাকে বলা হবে ‘ইমামুল মুসলিমীন’ বা ‘খলীফাতুল মুসলিমীন’। উক্ত হাদীছে ফেৎনা এবং দলাদলির সময় একজন মুসলিমের করণীয়ও বলে দেওয়া হয়েছে। আর তা হচ্ছে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ এবং তাদের খলীফার সাথে থাকা। আর মুসলিম খলীফার অবর্তমানে যাবতীয় দলাদলি ছেড়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ আঁকড়ে ধরে থাকা।
হাদীছটির অন্য বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে তিনবার বলেছিলেন, ‘হে হুযায়ফা! তুমি কুরআন শিখবে এবং তা মেনে চলবে’ (আবু দাঊদ, হা/৪২৪৬)।
হাদীছে উল্লেখিত ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ কথাটি নির্দিষ্ট কোনো দল বা সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালালে তা হবে মহা অন্যায়। যেমনটি কোনো কোনো মুসলিম দেশে আজ ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ নামধারী ভুঁইফোড় সংকীর্ণ দলের জন্ম হয়েছে, যারা ব্যাপক অর্থবোধক এ পরিভাষাটিকে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে দ্বিধা করছে না। যাহোক, যে ব্যক্তি সালাফে ছালেহীনের মূলনীতি অনুযায়ী কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ বুঝবে এবং তদ্নুযায়ী আমল করবে, সে-ই আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই তার অবস্থান হোক না কেন। এমনকি গভীর জঙ্গলে একাকী অবস্থানকারী ব্যক্তিও যদি নিঃস্বার্থভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মেনে চলে, সেও আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হবে। মনে রাখতে হবে, প্রচলিত সংগঠনগুলির মত আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হতে হলে কাউকে কোনো নেতার অনুমতির প্রয়োজন হয় না এবং কোনো সদস্য ফরম বা ভর্তি ফরমও পূরণ করতে হয় না। প্রয়োজন হয় না কোনো আমীর বা নেতার হাতে বায়‘আতের ও শপথ বাক্য পাঠের। শুধুমাত্র সালাফে ছালেহীনের মূলনীতি অনুযায়ী নিঃশর্তভাবে কুরআন-হাদীছ মেনে চললেই হয়।
বড় আফসোসের কথা হচ্ছে, খোদ আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের লোকেরাই এই মহান অর্থ অনুধাবনে চরম ব্যর্থ হচ্ছে এবং আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের বেশ অভাবও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি মুসলিম উম্মাহ্র বিভক্তির অন্যতম কারণও বটে।
যাহোক, কারো কারো মতে, যরূরী প্রয়োজনে সাংগঠনিকভাবে দা‘ওয়াতী কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে অতীব যরূরী কয়েকটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবেঃ
(১) সংগঠনে কুরআন-হাদীছ ও সালাফে ছালেহীনের মূলনীতি পরিপন্থী কোনো কার্যক্রম থাকবে না।
(২) সংগঠনে বায়‘আত, শপথ, অঙ্গীকার বা এজাতীয় কোনো কিছু থাকবে না। কারণ, বায়‘আত মুসলিম উম্মাহ্র একক খলীফা এবং দেশের সরকারের সাথে নির্দিষ্ট; কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল বা জামা‘আতের নেতার জন্য তা আদৌ বৈধ নয়।
(৩) ঈমানী মহান ও প্রশস্ত ভ্রাতৃত্বের গণ্ডিকে সাংগঠনিক সংকীর্ণ ভ্রাতৃত্বের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করার অপচেষ্টা থেকে দূরে থাকতে হবে।
(৪) সংগঠনের ভেতরের এবং বাইরের সকল মুসলিম ভাইয়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকতে হবে, একে অন্যের দোষত্রুটি না বলে ভাল দিকগুলি বলতে হবে এবং কারো মধ্যে বিদ্যমান ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের জন্য হিকমতের সাথে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
(৫) সংগঠনকে দা‘ওয়াতের একটি মাধ্যমের বাইরে অন্য কিছু মনে করা যাবে না; সংগঠন কখনই হক-বাতিলের মানদণ্ড বিবেচিত হবে না।
(৬) মানুষকে সংগঠনের পতাকাতলে আহ্বান না জানিয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের শীতল ছায়াতলে আহ্বান জানাতে হবে।
আমার ছোট্ট গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে যে, কোনো সংগঠনকে দা‘ওয়াতী কার্যক্রমের একটি মাধ্যমের বাইরে অন্য কিছু প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই মাধ্যম এক সময় পরিণত হয় মূল লক্ষ্যে, শুরু হয় দলের প্রতি অন্ধভক্তি এবং অন্যদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ও অভক্তি। সংগঠনে থাকলে অসৎ মানুষটিও হয়ে যায় দুধে ধোয়া; কিন্তু সংগঠনের বাইরে চলে গেলে সোনার মানুষটিও পরিণত হয় নিকৃষ্ট ব্যক্তিত্বে। এই মিত্রতা ও শত্রুতার মানদণ্ড হয় কেবল দলীয় গণ্ডি; এখানে আক্বীদা, আমল, পরহেযগারিতা ও যোগ্যতার কোনো মূল্য থাকে না। প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে; সেখানকার ছহীহ আক্বীদায় বিশ্বাসের দাবীদার কয়েকটি সংগঠনের মধ্যে সম্পর্কের এতবেশী টানাপড়েন হয়েছে যে, একটি সংগঠন তাদের সাপ্তাহিক পত্রিকায় তাদের মজলিসে শূরার সিদ্ধান্তানুযায়ী বাকী তিনটি সংগঠন এবং সেগুলোর কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে বলেছে, তাদেরকে কোনো প্রোগ্রামে ডাকা হবে না এবং তাদের কারো কারো সাথে কোনো প্রকার সহযোগিতার পথ খোলা থাকবে না।([২]) এই যদি হয় সঠিক আক্বীদা পোষণকারী সংগঠনের অবস্থা, তাহলে অন্যদের অবস্থা কি হতে পারে! মূলতঃ সারা দুনিয়ার সব সংগঠনের অবস্থা প্রায় একই!
সংগঠন যেহেতু দা‘ওয়াতের একটি মাধ্যমের বাইরে অন্য কিছু নয়, সেহেতু প্রত্যেকটি দাঈর সেখানে যোগ দেওয়াও অপরিহার্য নয়। বরং একজন দাঈ তার সাধ্যানুযায়ী দা‘ওয়াতের যে কোনো বৈধ মাধ্যমে দা‘ওয়াতী কার্যক্রম চালাতে পারেন। তবে দাঈদের মধ্যে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা একান্ত কাম্য। নানামুখী দা‘ওয়াতী কার্যক্রমে পরস্পর পরস্পরকে আহ্বান করতে হবে এবং আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। মনে কারো প্রতি হিংসার আশ্রয় দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, ইসলামে কোনো বৈধ কাজ করতে গিয়ে কোনো হারাম কাজ করা নিষেধ। কিন্তু সংগঠন নামক এই বৈধ মাধ্যমটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে একজন ব্যক্তি কাবীরা গোনাহ করতেও দ্বিধাবোধ করছে না; সেখানে চলছে কাঁদা ছোড়াছুড়ি, চলছে মরা ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ! অতএব, নির্দিষ্ট কোনো দল বা সংগঠনের শিকলে নিজেকে বন্দী না করে যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের আক্বীদা ছহীহ, তাদের সবাইকে ভালকাজে সহযোগিতা করা ভাল; পক্ষান্তরে তাদের দোষত্রুটি ও মন্দ দিকগুলি সংশোধনের জন্য তাদেরকে নছীহত করা উচিৎ।
বিভিন্ন দল, জামা‘আত ও সংগঠনের বৈধতা কতটুকু এবং সেগুলো সম্পর্কে একজন মুসলিমের ভূমিকা কি হবে তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হওয়া দরকার। শায়খ ছালেহ আল-ফাওযানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যুবক এবং সাধারণ মানুষদেরকে দলাদলি ও বিভক্তি সম্পর্কে সতর্ক করা ওলামায়ে কেরামের জন্য জায়েয আছে কি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, যুবক এবং সাধারণ মানুষদেরকে নিষিদ্ধ দলাদলি থেকে সতর্ক করা যরূরী। তা হলে মানুষ জাগ্রত জ্ঞান সহকারে থাকতে পারবে। কেননা আজ সাধারণ মানুষও হক মনে করে কিছু কিছু দলের ধোঁকায় পড়ে যাচ্ছে। আর আমরা যদি দলাদলি এবং বিভক্তির ভয়াবহতা মানুষদেরকে না বলি, তাহলে তাদের মধ্যে ভ্রষ্টতা প্রবেশ করবে। শিক্ষিত সমাজের চেয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ভয়টা আরো বেশী। কেননা উলামায়ে কেরাম চুপ থাকলে সাধারণ মানুষ মনে করবে, এটিই হচ্ছে হক।([৩])
এই সংকলনে আমরা বিভিন্ন ইসলামী দল ও সংগঠন এবং ইমারত ও বায়‘আত সম্পর্কে প্রসিদ্ধ কয়েকজন আলেমের বক্তব্য তুলে ধরলাম। সংকলনটির কিছু কিছু প্রশ্ন প্রায় একই। কিন্তু প্রশ্নগুলি বিভিন্ন আলেমের কাছে উপস্থাপিত হওয়ায় এবং পুনরাবৃত্ত একটি প্রশ্নে যে বাড়তি জ্ঞানের কথা রয়েছে, তা ঐ একই ধরনের অন্য প্রশ্নে না হওয়ায় আমরা সেগুলো ছাড়িনি। তাছাড়া একই প্রশ্নের জবাবে একাধিক আলেমের দৃষ্টিভঙ্গি জানাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং আমাদের নিয়্যত পরিচ্ছন্ন করে দিন। আমীন!
তথ্যসূত্র :
[১] লালকাঈ, শারহু উছূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস-সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, আছার নং ৫০।
[২] দেখুনঃ লাহোর থেকে প্রকাশিত মারকাযী জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তানের সাপ্তাহিক পত্রিকা, ১১ মে ২০১৩ সংখ্যা, পৃ: ৮।
[৩] ছালেহ আল-ফাওযান, আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ ফিল মানাহিজিল জাদীদাহ, পৃ: ৬৮।