সলাতে মুবাশ্‌শির (পর্ব ৩)

রচনায় : আব্দুল হামীদ ফাইযী

নামাযের মাহাত্ম

মহান আল্লাহ বলেন,
اُتْلُ مَا أُوْحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلاَةَ، إِنَّ الصَّلاَةَ تَنْهى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ، وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَر
অর্থাৎ, তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট গ্র ন্থ পাঠ কর এবং যথাযথভাবে নামায পড়। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে। আর অবশ্যই আল্লাহর যিক্‌র (স্মরণই) সর্বশ্রেষ্ঠ।১
নামায মুমিনের চক্ষুকে শীতল করে, তার যাবতীয় ছোট ছোট গুনাহ বা লঘু ও উপপাপকে মোচন করে দেয়। হযরত আবু হুরাইরা বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “কি অভিমত তোমাদের, যদি তোমাদের কারো দরজার সামনেই একটি নদী থাকে এবং সেই নদীতে সে প্রত্যহ পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে কি? সকলে বলল, ‘না, তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না।’ তিনি বললেন, “অনুরুপই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উপমা। ঐ নামায সমূহের ফলেই (নামাযীর) সমস্ত গুনাহকে আল্লাহ মোচন করে দেন।”২
আল্লাহর রসূল (সা) বলেন, “কাবীরাহ গুনাহ না করলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআহ থেকে অপর জুমুআহ -এর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত পাপসমূহের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)।”৩

হযরত আবু উসমান (রা.) বলেন, একদা একটি গাছের নিচে আমি সালমান (রা.) এর সাথে (বসে) ছিলাম। তিনি গাছের একটি শুষ্ক ডাল ধরে হিলিয়ে দিলেন। এতে ডালের সমস্ত পাতাগুলি ঝড়ে গেল। অত:পর তিনি বললেন, ‘হে আবু উসমান! তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না কি যে, কেন আমি এরুপ করলাম?’ আমি বললাম, ‘কেন করলেন?’ তিনি বললেন, ‘একদা আমিও আল্লাহর রসূল (সা.) এর সাথে গাছের নিচে ছিলাম। তিনি আমার সামনে অনুরুপ করলেন; গাছের একটি শুষ্ক ডাল ধরে হিলিয়ে দিলেন। এতে তার সমস্ত পাতা খসে পড়ল। অত:পর বললেন, “হে সালমান! তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না কি যে, কেন আমি এরুপ করলাম?” আমি বললাম, কেন করলেন? তিনি উত্তরে বললেন, “মুসলিম যখন সুন্দরভাবে ওযু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে তখন তার পাপরাশি ঠিক ঐভাবেই ঝরে যায় যেভাবে এই পাতাগুলো ঝরে গেল। আর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন, ৪
وَأَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَىِ النَّهَارِ وَزُلَفاً مِّنَ اللَّيْلِ، إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّآتِ، ذلِكَ ذِكْرى لِلذَّاكِرِيْنَ
অর্থাৎ, আর তুমি দিনের দু’ প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথামাংশে নামায কায়েম কর। পুণ্যরাশি অবশ্যই পাপরাশিকে দূরীভূত করে দেয়। (আল্লাহর) স্মরণকারীদের জন্য এ হল এক স্মরণ।৫

মহানবী (সা.) বলেন, “বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন তার সে তার সমস্ত গুনাহকে নিয়ে তার মাথায় ও দুই কাঁধে রাখা হয়। অত:পর সে যখনই রুকূ ও সিজদা করে, তখনই একটি একটি করে সমস্ত গুনাহগুলি ঝরে পড়ে যায়।”৬

নামাযের গুরুত্ব

নামায ও তার গুরুত্বের কথা কুরআন মাজীদের বহু জায়গাতেই আলোচিত হয়েছে। কোথাও নামায কায়েম করার আদেশ দিয়ে, কোথাও নামাযীর প্রশংসা ও প্রতিদান এবং বেনামাযীর নিন্দা ও শাস্তি বর্ণনা করে, আল্লাহ তাআলা নামাযের প্রতি বড় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এক স্থানে তিনি বলেন,
فإنْ تَابُوْا وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّيْنِ
অর্থাৎ, তারপর তারা যদি তওবা করে নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। (নচেৎ নয়।)
অন্যত্র বলেন,
 مُنِيْبِيْنَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوْهُ وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَلاَ تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ
অর্থাৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তাঁর অভিমুখী হও; তাঁকে ভয় কর, যথাযথভাবে নামায পড়, আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।৮
কুরআন মাজীদে নামাযকে মহান আল্লাহ ‘ঈমান’ বলে আখ্যায়ন করেছেন, তিনি বলেন,
ৎوَمَا كَانَ اللّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ: (১৪৩) سورة البقرة
অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদের (কা’বার দিক ছাড়া বায়তুল মাকদেসের দিকে মুখ করে আদায়কৃত পূর্বের) ঈমান (নামায) কে বরবাদ করবেন না।
নামায মু’মিনের ঈমান ও মুসলিমের ইসলামের নিদর্শন। মহানবী (সা) বলেন,

“ইসলাম ও শির্ক এবং কুফরের মাঝে পার্থক্য নির্বাচনকারী হল এই নামায।”১০

কোন আমল ত্যাগ করার ফলে কেউকাফের হয়ে যায় না। কিন্তু সাহাবাগণ নামায ত্যাগ করাকে কুফরী মনে করতেন।১১
হযরত ইবনে মাসউদ বলেন, “যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করে তার দ্বীনই নেই।”১২
হযরত আবূ দারদা বলেন, “যার নামায নেই তার ঈমানই নেই।”১৩
প্রিয় নবী আরো বলেন,

“আমাদের ও ওদের (কাফেরদের) মাঝে চুক্তিই হল নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি তা ত্যাগ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে (বা কুফরী করবে।)১৪

তিনি আরো বলেন, “পাঁচ ওয়াক্ত নামায আল্লাহ বান্দাগণের উপর ফরয করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা যথার্থরুপে আদায় করবে এবং তাতে গুরুত্ব দিয়ে তার কিছুও বিনষ্ট করবে না, সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি আছে যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি তা আদায় করবে না, সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দেবেন, নচেৎ ইচ্ছা হলে জান্নাতেও দিতে পারেন।” ১৫
পূর্বোক্ত আয়াত ও হাদীসের ভিত্তিতে বড় বড় বহু উলামাগণ বলেছেন যে, বেনামাযী কাফের। কোন মুসলিম (নামাযী) নারীর সাথে তার বিবাহ্‌ হতে পারে না, তার যবাইকৃত পশুর মাংস হালাল হয় না, সে মারা গেলে তার জানাযা পড়া হবে না, মুসলিম (নামাযী) ছেলেরা তার ওয়ারিস হবে না বা সেও নামাযী বাপের ওয়ারিস হবে না এবং তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা হবে না — ইত্যাদি।
অবশ্য শেষোক্ত হাদীস এবং অনুরুপ অন্যান্য হাদীসের ভিত্তিতে অন্যান্য আলেমগণ বলেন যে, ‘বেনামাযী কাফের নয়, তবে নামায ত্যাগ করা কাফেরের কাজ বটে।’১৬

যাইবা হোক উক্ত আয়াত ওহাদীসসমূহে নামাযের বিরাট গুরুত্ব স্পষ্ট। নামায হল দ্বীনের খুঁটি।১৭ দ্বীনের পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে এটাই হল দ্বিতীয় বুনিয়াদ।১৮
তাই তো প্রিয় নবী (সা.) জীবনের শেষ মুহূর্তে মরণ-শয্যায় শায়িত অবস্থাতেও নামাযের জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। ইন্তেকালের পূর্বে শেষ উপদেশে তিনি নামাযের গুরুত্ব সম্বন্ধে উম্মতকে সচেতন করে গেলেন। বললেন, “নামায! নামায! আর ক্রীতদাস-দাসী (এর ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো।)১৯
সাবালক হলেই মুসলিমের উপর নামায ফরয হয়। তবুও অভ্যস্ত করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহর নবী (সা) বলেন, “তোমরা তোমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের বয়স ৭ বছর হলেই নামাযের আদেশ দাও। ১০ বছর বয়সে নামাযে অ ভ্যা সী না হলে তাদেরকে প্রহার কর। আর তাদের প্রত্যেকের বিছানা পৃথক করে দাও।”২০
সব ওয়াক্তের নামায নয়, কেবলমাত্র এক ওয়াক্তের আসরের নামায ছুটে গেলে বা না পড়া হলে তার ক্ষতির পরিমাণ বুঝাতে প্রিয় নবী (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি আসরের নামায ত্যাগ করে, সে ব্যক্তির আমল পন্ড হয়ে যায়।” ২১
তিনি (সা) আরো বলেন, “যে ব্যক্তির আসরের নামায ছুটে গেল, তার যেন পরিবার ও ধন-মাল লুণ্ঠন হয়ে গেল।”২২
মহান আল্লাহ বলেন,
فخلفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلاَةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا
অর্থাৎ, ওদের পর এল এমন (অপদার্থ) পরবর্তীদল; যারা নামায নষ্ট করল ও কুপ্রবৃত্তি-পরবশ হল। সুতরাং ওরা অচিরেই কঠিন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে।২৩
আল্লাহ তাআলা বলেন,
(فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلاَتِهِمْ سَاهُوْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ يُرَاؤُوْنَ)
অর্থাৎ, সুতরাং দুর্ভোগ সেই সকল নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে।২৪
বলা বাহুল্য, নামাযী হয়েও নামাযে গাফলতি করার কারণে যদি দোযখের দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়, তাহলে বেনামাযী হয়ে কত বড় দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে তা অনুমেয়।
মরণের পরপারে মধ্যজগতে নামাযে উদাসীন ও শৈথিল্যকারী ব্যক্তির মাথায় কিয়ামত অবধি পাথর ঠুকে ঠুকে মারা হবে।২৫
নামায আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্কের এক সেতুবন্ধ। “কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে সর্বা গ্রে যে আমলের হিসাব নেওয়া হবে তা হল নামায। সুতরাং তা সঠিক হয়ে থাকলে তার অন্যান্য আমলও সঠিক বলে বিবেচিত হবে। নচেৎ অন্যান্য সকল আমল নিষ্ফল ও ব্যর্থ হবে।”২৬
নামায এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তার শর্তাবলী বর্তমান থাকা কালে তা (নাবালক শিশু, পাগল ও ঋতুমতী মহিলা ছাড়া) কারো জন্য কোন অবস্থাতেই মাফ নয়। এমন কি যুদ্ধের ময়দানে প্রাণহ্‌ন্তা রক্ত-পিপাসু শত্রুদলের সামনেও নয়!২৭
অসুস্থ অবস্থায় খাড়া হয়ে না পারলে বসে, বসে না পারলে কাৎ হয়ে শুয়েও নামায পড়তেই হবে।২৮
ইশারা-ইঙ্গিতে রুকু-সিজদা না করতে পারলে মনে মনে নিয়তেও নামায পড়তে হবে। চেষ্টা সত্ত্বেও পবিত্র থাকতে অক্ষম হলেও ঐ অবস্থাতেই নামায ফরয।২৯

তথ্যসূত্র :

  1. সূরা আল-আনকাবূত, আয়াত নং-৪৫
  2. বুখারী ৫২৮নং, মুসলিম ৬৬৭ নং, তিরমিযী, নাসাঈ
  3. মুসলিম ২৩৩নং, তিরমিযী প্রমুখ।
  4. সূরা হূদ ১১৪ আয়াত
  5. আহ্‌মদ, নাসাঈ, ত্বাবারানী, সহীহ তারগীব ৩৫৬নং
  6. বাইহাকী, সহীহুল জামে ১৬৭১নং
  7. সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত নং-১১
  8. সূরা আর-রুম, আয়াত নং-৩১
  9. সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত নং-১৪৩
  10. মুসলিম ৮২নং, মিশকাত হা/৫৬৯
  11. তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৭৯।
  12. ইবনে আবী শাইবাই, ত্বাবারানীর কাবীর, সহীহ তারগীব ৫৭১নং
  13. ইবনে আব্দুল বার, প্রমুখ, সহীহ তারগীব ৫৭২নং
  14. তিরমিযী ২৬২১, ইবনে মাজাহ ১০৭৯ নং
  15. মুওয়াত্তা মালেক, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে হিব্বান, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ৩৬৩ নং
  16. ইবনে বায, ইবনে উসাইমীন ও আলবানীর ফতোয়া দ্রষ্টব্য
  17. সহীহ তিরমিযী ২১১০, সহীহ ইবনে মাজাহ ৩৯৭৩ নং।
  18. বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ হা/৪
  19. সহীহুল জামে’ হা/৩৮৭৩
  20. আবু দাউদ, মিশকাত হা/৫৭২।
  21. বুখারী ৫৫৩, নাসাঈ
  22. মালেক, বুখারী ৫৫২, মুসলিম ৬২৬ নং প্রমুখ
  23. সূরা মারইয়াম আয়াত নং-৫৯
  24. সূলা আল-মাউন, আয়াত নং ৪-৬।
  25. বুখারী ১১৪৩নং।
  26. ত্বাবারানী, সহীহ আত-তারগীব ৩৬৯নং।
  27. সূরা আন-নিসা, আয়াত নং-১০২।
  28. বুখারী, মিশকাত হা/১২৪৮।
  29. ইবনে উসাইমীন, কাইফা ইয়্যাতাত্বাহ্‌হারুল মারীযু অয়্যুসাল্লী দ্রষ্টব্য

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button