
আল কুরআনে মুত্তাকীর পরিচয়
আল কুরআনে মুত্তাকীর পরিচয়
রচনায়: ড. আ.ব.ম সাঈফুল ইসলাম সিদ্দীকী
শরীয়তের পরিভাষায় যে কাজ করলে পাপ হবে, এমন কাজ হতে বিরত থাকার নাম ‘তাকওয়া’। আর যিনি এ কাজ করেন তাকেই ‘মুত্তাকী’ বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর ভয়ে সকল পাপাচার, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার এবং এ জাতীয় সকল কাজ হতে নিজেকে বিরত রেখে পবিত্র কুরআনএবং ছহীহ হাদিস অনুসারে নিজ জীবন পরিচালনার নাম ‘তাকওয়া’। আর যিনি এসব কাজ পরিহার করে ইসলামী শরী’আহ অনুযায়ী চলেন তাকে ‘মুত্তাকী’ বলা হয় ।
আল–কুরআনে মুত্তাকীদেরকে বিভিন্নভাবে পরিচিত করা হয়েছে , গুণান্বিত করা হয়েছে বিভিন্ন গুনে। নিম্নে বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত মুত্তাকীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা হল :-
১. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসঃ আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কারো থেকে জন্মলাভ করেননি। তাঁকে সৃষ্টিকর্তা , রিযিকদাতা, এবং পালনকর্তা হিসাবে মেনে নিয়ে তাঁর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে নিষ্ঠার সাথে যারা তাঁর ইবাদাত করে, তাঁরাই মুত্তাকী । ইরশাদ হচ্ছে
يُؤْمِنُونَبِاللَّهِ‘ তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে’ ( সূরা আলে ইমরান ১১৪)
২.পরকালে বিশ্বাসঃ পরকালের প্রতি বিশ্বাসমু ত্তাকীর অন্যতম পরিচয়।মানুষের জীবন ইহলোকেই শেষ হয় না,যেমন অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা মনে করে থাকে। পরোলোকের প্রতি বিশ্বাসের কারনে ইহলোকে সে সকল মন্দ কর্ম পরিহার করে। পরলোকের চিরস্থায়ী সুখ লাভের জন্যই ইহলোকে সে এত কষ্ট করে তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে। ইরশাদ হচ্ছে
وَبِالْآخِرَةِهُمْيُوقِنُونَ‘তারা আখেরাতের দৃঢ় বিশ্বাস রাখে’ (সুরা বাকারা ৪) ।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে ‘يُؤْمِنُونَبِاللَّهِوَالْيَوْمِالْآخِرِ’ ‘তারা আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি ঈমান রাখে ’ (আলে ইমরান ১১৪) ।
৩. গায়েবের প্রতি বিশ্বাসঃ মানুষ যাকে সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও পালনকর্তা বলে মানে কিন্তু তাঁকে দেখতে পায় না । আর না দেখতে পায় তাদের জন্য সৃষ্ট জান্নাত, জাহান্নাম এবং নির্ধারিত পুরষ্কার বা শাস্তি। এর পরেও তারা এসবের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে, আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে সকল প্রকার অন্যায় অবিচার হতে নিজেকে দূরে রাখে। এরাই হল মুত্তাকী। এদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন
‘الَّذِينَيُؤْمِنُونَبِالْغَيْبِ’ ‘তারা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখে ’ (বাকারাহ ৩)।
৪.সালাত কায়েমঃ ইসলামী শারীআতে ঈমানের পরেই ছালাতের স্থান। সালাত কায়েম করতে বারবার তাকীদ দেয়া হয়েছে আল-কুরআনে। এ সালাত মানুষকে অশ্লীল কাজ হতে বিরত রাখে। ইরশাদ হচ্ছে
‘إِنَّالصَّلَاةَتَنْهَىٰعَنِالْفَحْشَاءِوَالْمُنكَرِ ’
অনুবাদ : ‘নিশ্চয় সালাত সকল অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কাজ হ’তে বিরত রাখে ’ ( সূরা আনকাবূত ৪৫)
৫.আল-কুরআনের প্রতি বিশ্বাসঃ আল-কুরআন মুত্তাকীদের হিদায়াতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে – ‘هُدًىلِّلْمُتَّقِينَ’ ‘কুরআন মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শক’ (বাকারাহ ২)।
মুমিন-মুত্তাকী ছাড়া আল-কুরআন আর কাউকে সৎ পথ প্রদর্শন করে না । ইরশাদ হচ্ছে – ‘وَنُنَزِّلُمِنَالْقُرْآنِمَاهُوَشِفَاءٌوَرَحْمَةٌلِّلْمُؤْمِنِينَ ۙوَلَايَزِيدُالظَّالِمِينَإِلَّاخَسَارًا’
‘আমি কুরআন এমন বিষয়ে নাযিল করি যা রোগের নিরাময়কারী এবং মুমিনদের জন্য রহমত স্বরুপ। আর গোনহাগারদের তো এতে ক্ষতিই বৃদ্ধি পায় ’ (বনী ইসরাঈল ৮২) ।
তাই মুত্তাকীদের অন্যতম পরিচয় হল , তারা আল-কুরআনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হবে । ইরশাদ হচ্ছে –
‘وَالَّذِينَيُؤْمِنُونَبِمَاأُنزِلَإِلَيْكَ’ ‘ যারা আপনার প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে তার প্রতি বিশ্বাস রাখে ’ (বাকারা ৪) ।
৬.পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাসঃ মুত্তাকীগণ শুধু আল-কুরআনেই বিশ্বাসী নয় , তারা পূর্ববর্তী সকল নবীদের উপর নাযিলকৃত ছহীফা ও গ্রন্থের প্রতিও বিশ্বাসী । ইরশাদ হচ্ছে –
‘وَمَاأُنزِلَمِنقَبْلِكَ’
(হে নবী) ‘তারা বিশ্বাস রাখে আপনার পূর্ববর্তী নবীদের উপর যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতিও ’ (বাকারা ৪) ।
৭.ফিরিশতাগণের প্রতি বিশ্বাসঃ মুত্তাকীরা আল্লাহর সৃষ্ট জীব ফিরিশতাগণের প্রতি বিশ্বাস রাখে । আল্লাহ তা’আলা অগনিত ফিরিশতা সৃষ্টি করে তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করেছেন । তাঁরা সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ পালনে প্রস্তুত থাকে । আল কুরআনের বহু স্থানে ফিরিশতাগণের কথা উল্লেখ রয়েছে ।
ইরশাদ হচ্ছে ‘إِنَّاللَّهَوَمَلَائِكَتَهُيُصَلُّونَعَلَىالنَّبِيِّ ’ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং ফিরিশতাকুল তাঁর নবীর উপর রহমত প্রেরন করে’ (আহযাব ৫৬) ।
আরো ইরশাদ হচ্ছে,يَعْلَمُونَمَاتَفْعَلُونَكِرَامًاكَاتِبِينَ ‘দু’জন সন্মানিত ফিরিশতা তোমাদের সকল কাজের খবর রাখে’ (ইনফিতার ১১-১২)।
উপরে বর্ণিত বিষয়গুলির অধিকাংশই নিম্নের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে । ইরশাদ হচ্ছে,
آمَنَالرَّسُولُبِمَاأُنزِلَإِلَيْهِمِنرَّبِّهِوَالْمُؤْمِنُونَ ۚكُلٌّآمَنَبِاللَّهِوَمَلَائِكَتِهِوَكُتُبِهِوَرُسُلِهِلَانُفَرِّقُبَيْنَأَحَدٍمِّنرُّسُلِهِ‘
রাসূল ঈমান এনেছেন যা তাঁর প্রভুর কাছ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে, আর বিশ্বাসীরাও। তারা সবাই ঈমান এনেছে আল্লাহ্তে, আর তাঁর ফিরিশ্তাগণে, আর তাঁর কিতাবসমূহে, আর তাঁর রসূলগণের প্রতি আমরা তাঁর রসূলদের কোনোজনের মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না ’ (বাকারাহ ২৮৫) ।
৮. যাকাত আদায় : আল-কুরআনের বহু স্থানে সালাতের সাথে যাকাতের উল্লেখ করা হয়েছ।
ইরশাদ হচ্ছে وَأَقِيمُواالصَّلَاةَوَآتُواالزَّكَاةَوَارْكَعُوامَعَالرَّاكِعِينَ
‘আর তোমরা সালাত কায়েম করো ও যাকাত আদায় করো, আর রুকুকারীদের সাথে রুকু করো। ’ (বাকারা ৪৩)।
আরো ইরশাদ হচ্ছে
فَأَقِيمُواالصَّلَاةَوَآتُواالزَّكَاةَوَأَطِيعُوااللَّهَوَرَسُولَهُ‘
তখন সালাত কায়েম করো ও যাকাত আদায় করো, আর আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আজ্ঞাপালন করো।’ (মুজাদালাহ ১৩) ।
তাই মুত্তাকীগণ সালাত কায়েমের সাথে সাথে যাকাতও আদায় করে থাকে ।
ইরশাদ হচ্ছে
وَمِمَّارَزَقْنَاهُمْيُنفِقُونَ‘এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে তারা ব্যায় করে’ (বাকারা ৩) ।
৯. সৎ কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ : সৎ কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করা মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন – يُؤْمِنُونَبِاللَّهِوَالْيَوْمِالْآخِرِوَيَأْمُرُونَبِالْمَعْرُوفِوَيَنْهَوْنَعَنِالْمُنكَرِوَيُسَارِعُونَفِيالْخَيْرَاتِ
‘তারা আল্লাহ্র প্রতি ও আখেরাতের দিনের প্রতি বিশ্বাস করে, আর তারা ন্যায়ের পথে নির্দেশ দেয় ও অন্যায় থেকে নিষেধ করে’ (আলে ইমরান ১১৪)।
১০.আল্লাহর প্রতি ভরসা করা : সকল কাজে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা বা ভরসা রাখা মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট। তারা বিপদে আপদে এবং বিপদ সংকুল অবস্থায় ভীত হয় না; বরং সকল কাজের ফলাফল আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করে। ইরশাদ হচ্ছে
وَعَلَىٰرَبِّهِمْيَتَوَكَّلُونَ‘ আর তারা তাদের প্রভুর প্রতি অবিচল আস্থা রাখে ’ (শূরা ৩৬)।
১১. ধৈর্য ধারণ করা : ছবর বা ধৈর্য মুত্তাকীদের অন্যতম গুন।মুত্তাকীরা কখনোও বিপদে অধৈর্য হয়ে পড়েনা। সহিষ্ণুতা তাদের ভূষন।তারা সংকট অবস্থায় ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে থাকে। ইরশাদ হচ্ছে
وَاسْتَعِينُوابِالصَّبْرِوَالصَّلَاةِ ‘তোমরা ধৈর্য ধরে ও সালাত পড়ে সাহায্য কামনা করো।’ (বাকারা ৪৫) ।
১২. গুরুতর পাপ থেকে বিরত থাকা : মুত্তাকীগন সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলে। ফলে তাদের দ্বারা গুরুতর পাপ সংগঠিত হয় না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন, وَالَّذِينَيَجْتَنِبُونَكَبَائِرَالْإِثْمِوَالْفَوَاحِشَ‘তারা গুরুতর পাপ হতে বেঁচে থাকে এবং অশ্লীল কাজ হতেও’ (শূরা৩৭)।
১৩.সত্যবাদী হওয়া :– মিথ্যা সকল পাপের উৎস, যা মানুষকে কুপথে নিয়ে যেতে সহযোগীতা করে। আর সত্য হল মুক্তিদাতা অন্ধকারের পাঞ্জেরী। মিথ্যা জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে, আর সত্য জান্নাতের দিকে। তাই মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে সত্য বলা।
ইরশাদ হচ্ছে وَالَّذِيجَاءَبِالصِّدْقِوَصَدَّقَبِهِ ۙأُولَٰئِكَهُمُالْمُتَّقُونَ
‘আর যারা সত্য নিয়ে এসেছে ও একে সত্য বলে স্বীকার করেছে এরাই খোদ মুত্তাকী।’ (যুমার ৩৩) ।
এ ছাড়াও বহু বৈশিষ্ট আল-কুরআনে উল্লেখ রয়েছে,যদ্বারা মুত্তাকীদেরকে সহজেই চেনা যায়। একই আয়াতে মুত্তাকীদের বহু গুনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এমন একটি আয়াত হলঃ
وَلَٰكِنَّالْبِرَّمَنْآمَنَبِاللَّهِوَالْيَوْمِالْآخِرِوَالْمَلَائِكَةِوَالْكِتَابِوَالنَّبِيِّينَوَآتَىالْمَالَعَلَىٰحُبِّهِذَوِيالْقُرْبَىٰوَالْيَتَامَىٰوَالْمَسَاكِينَوَابْنَالسَّبِيلِوَالسَّائِلِينَوَفِيالرِّقَابِوَأَقَامَالصَّلَاةَوَآتَىالزَّكَاةَوَالْمُوفُونَبِعَهْدِهِمْإِذَاعَاهَدُوا
ۖوَالصَّابِرِينَفِيالْبَأْسَاءِوَالضَّرَّاءِوَحِينَالْبَأْسِ
ۗأُولَٰئِكَالَّذِينَصَدَقُوا ۖ
وَأُولَٰئِكَهُمُالْمُتَّقُونَ
অনুবাদ : তবে ধর্মনিষ্ঠা হচ্ছে যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আর আখেরাতের দিনের প্রতি,আর ফিরিশ্তাদের প্রতি, আর গ্রন্থখানিতে, আর নবীদের প্রতি; আর যে তাঁর প্রতি মহব্বতবশতঃ ধন দান করে আত্মীয়-স্বজনদের, আর এতীমদের, আর মিসকিনদের, আর পথচারীদের, আর ভিখারীদের, আর দাসদের মুক্তিপণ বাবদ, আর যে সালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করেচ আর যারা প্রতিজ্ঞা করার পরে তাদের ওয়াদা রক্ষা করে, আর অভাব-অনটনে ও আপৎকালে ও আতঙ্কের সময়ে ধৈর্যশীলদের। এরাই তারা যারা সত্যনিষ্ঠ, আর এরা নিজেরাই ধর্মপরায়ণ।
উপসংহারঃ এতদ আলোচনায় ইহাই প্রমানিত হচ্ছে যে, মুত্তাকীরা আল্লাহর ভয়ে ভীত ও তাঁর প্রদর্শিত পথের একমাত্র যাত্রী। যাদের মধ্যে প্রতিভাত হবে সকল সদগুনাবলী। অর্থাৎ যারা আল্লাহকে এক বলে জানবে, তাঁর সাথে কোন শরীক করবে না, তাঁর রাসুল, কিতাব, ফিরিশতা, পরকাল, গায়েব ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস রাখবে। এরপর তারা নিয়মিত সালাত কায়েম করবে, আদায় করবে যাকাত, গরীব, মিসকীন, ইয়াতিম এবং মুসাফিরদের করবে সাহায্য, বিপদে হবে ধৈর্যশীল সহিষ্ণু। আল্লাহর প্রতি থাকবে অবিচল আস্থা ও ভরসা । তারা সৎ কাজের করবে আদেশ এবং বিরত থাকতে নির্দেশ দেবে অসৎ কাজ থেকে। তারা পরস্পর সত্য এবং ধৈর্যের উপদেশ দেবে। এসব গুনে যারা গুণান্বিত হবে তারা নিঃসন্দেহে হবে বেহেশতের অধিবাসী। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে মুত্তাকী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন ।