ইসলামে সত্যবাদিতার গুরুত্ব ও মিথ্যার পরিণাম

 ইসলামে সত্যবাদিতা ও মিথ্যার পরিণাম

الصدق: আরবিতে صدق বলা হয়―مطابقة الخبر للواقع অর্থাৎ বাস্তব অনুযায়ী সংবাদ দেয়া صدق তথা সত্যবাদিতা।

এর বিপরীতে রয়েছে الكذب তথা মিথ্যাবাদিতা। আর তা হলো বাস্তবতার উল্টো সংবাদ দেয়া।

সত্যবাদিতার মর্যাদা :—এটি একটি মহৎ গুণ। শরিয়ত যে সকল চারিত্রিক দিকের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে সেগুলোর মাঝে সত্যবাদিতা অন্যতম। এটি একটি সুউচ্চ আদর্শ। মহামানবগণই এ গুণটি অর্জন করেন। আর অপদার্থরা এ থেকে পিছিয়ে থাকে। এ কারণেই এটি ছিল সমস্ত নবীগণের অবিচ্ছিন্ন গুণ। ঠিক এর উল্টো ছিল মুনাফেকদের অবস্থা। এ বিষয়ে উৎসাহ দেয় এমন অনেক দলিল প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন―

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।’[i]

আব্দুল­হ ইবনে মাসঊদ থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―

عليكم بالصدق، فإن الصدق يهدي إلى البر، وإن البر يهدي إلى الجنة، وما يزال الرجل يصدق ويتحرى الصدق حتى يكتب عند الله صديقاً، وإياكم والكذب، فإن الكذب يهدي إلى الفجور، وإن الفجور يهدي إلى النار، وما يزال الرجل يكذب ويتحرى الكذب حتى يكتب عند الله كذاباً

‘তোমরা সত্যবাদিতা হও। কেননা সত্য মানুষকে পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। বান্দা সত্য কথাকে আঁকড়ে ধরলে এক সময় সে আল্লাহর নিকট সিদ্দিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তোমরা মিথ্যা বর্জন কর। কেননা মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে ধাবিত করে আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। বান্দা মিথ্যার আশ্রয় নিতে থাকলে একসময় আল্লাহর দরবারে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।’- মুসলিম : ৪৭২১

সত্যবাদিতার প্রকারভেদ

সত্যবাদিতা তিন প্রকার।

(১) الصدق بالقلب অন্তরের সততা : মুমিন বান্দা ঈমানের ক্ষেত্রে আন্তরিক ভাবে সত্যবাদী হবে, যাতে করে বাহ্যিক রূপ ভিতর গত অবস্থার বিপরীত না হয় এবং আমল যেন দৃঢ় বিশ্বাসের বিপরীত না হয়।

(২) الصدق بالأفعال কর্মের সততা : এটি বান্দা ও আল্লাহর মাঝে হতে পারে, আবার বান্দা ও মাখলুকের মাঝেও হতে পারে। মোমিন ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার হুকুমের বাস্তবায়ন ঘটাবে এবং ধোঁকা দেবে না। আর ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করবে না। আল্লাহ বলেন―

مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ

মুমিনদের মাঝে এমন কতিপয় মহাপুরুষ রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।

(৩) الصدق بالأقوال কথায় সততা : কোন ব্যক্তি বাস্তবতার বিপরীত সংবাদ না দেয়া, আর কথা ও কাজে অমিল না হওয়া। আল্লাহ বলেন―

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ

হে ঈমানদার বান্দাগণ, তোমরা যা কর না তা কেন বল ? আল্লাহর নিকট কঠিন অপরাধ হলো যা তোমরা কর না, তা সম্পর্কে তোমাদের বলা।[ii]

সত্যের ফলাফল

সত্যের ফলাফল অনেক। তন্মধ্যে―

(১) সত্য নেক আমলের দিকে ধাবিত করে আর নেক আমল জান্নাতের পথ দেখায়।

(২) সত্যবাদী আল্লাহ তাআলা ও মানুষের নিকট প্রিয়।

(৩) সত্য মানুষকে ইহকাল ও পরকালের ক্ষতি থেকে সংরক্ষণ করে।

সত্যের বিপরীত মিথ্যা

মিথ্যা এমন একটি কাজ যা ইচ্ছাকৃত ও উপহাস―উভয় অবস্থাতেই নিষিদ্ধ।

প্রকারভেদ : এটি বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন :―

(১) আল্লাহর উপর মিথ্যা-রোপ : যেমন―আল্লাহ তাআলার দ্বীনের ব্যাপারে না জেনে কথা বলা, অথবা আল্লাহ বলেননি এমন কিছু সম্পর্কে একথা বলা যে আল্লাহ তাআলা এটি বলেছেন। অথবা এভাবে বলা যে, আল্লাহ জানেন আমি এ কাজটি করেছি অথচ সে কাজটি করেনি―ইত্যাদি ইত্যাদি। এহেন কাজ মারাত্মক অপরাধ সন্দেহ নেই। আল্লাহ বলেন―

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ

আপনি বলুন, আমার প্রভু প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সর্বপ্রকার অশালীন কাজ হারাম করেছেন।[iii]

এরশাদ হয়েছে―

وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

আর আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের না জেনে কথা বলা।’[iv]

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন ―

إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ

‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা-রোপ করে তারা সফল হবে না।’

(২) রাসূলের ওপর মিথ্যা-রোপ : এটিও মারাত্মক মিথ্যা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―

إنّ كذباً علي ليس ككذب على أحد، فمن كذب علي متعمداً فليتبوأ مقعده من النار

আমার ওপর মিথ্যা-রোপ করা অন্য সাধারণ লোকের উপর মিথ্যা-রোপ করার মত নয়। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ওপর মিথ্যা বলল সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে স্থাপন করে নেয়।[v]

(৩) মিথ্যা সাক্ষ্য : অতএব দৃঢ়তার সাথে না জেনে কোন ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করা উচিত নয়।

(৪) اليمين الغموس : ইয়ামিনে গুমুস বলা হয় অতীতের কোন ঘটনার ব্যাপারে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়াকে।

(৫) ভিত্তিহীন কাহিনি তৈরি করা : অন্যকে হাসানো অথবা অবসর সময় কাটানোর জন্য এ ধরনের কাহিনি তৈরি করা হয়। উল্লেখিত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে সত্য ঘটনা বলাই যথেষ্ট।

(৬) না দেখে কোন কিছু দেখার দাবি করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―

إن أفرى الفرى أن يري الرجل عينيه ما لم تر.

সবচেয়ে কঠিন মিথ্যা হলো কোন ব্যক্তি স্বীয় চোখকে এমন কিছু দেখানোর চেষ্টা করল যা চোখে দেখেনি।

(৭) স্বপ্ন না দেখে মিথ্যা স্বপ্নের দাবি করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন —

 من تحلم بحلم لم يره كلف أن يعقد بين شعيرتين ولن يفعل.

যে ব্যক্তি কিছু না দেখে মিথ্যা স্বপ্নের দাবি করে, পরকালে তাকে দুটি চুলের মাঝে গিরা দিতে বলা হবে। অথচ সে তা পারবে না। এটি তার মিথ্যার শাস্তি।

ইমাম আহমদ রহ.-এর রেওয়ায়েতে আছে―عذب يوم القيامة কিয়ামতের দিবসে তার শাস্তিস্বরূপ দুটি চুলকে গিরা দিতে বলা হবে। কিন্তু সে তা পারবে না।

মিথ্যার শাস্তি :

মিথ্যার শাস্তি প্রসঙ্গে অনেক প্রমাণ রয়েছে। সামুরা ইবনে জুনদুব রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বপ্ন বর্ণনা করছেন। তার বর্ণনা নিম্নরূপ—

إنه آتاني اللية آتيان، وإنهما قالا لي : انطلق … ، قال : فانطلقنا فأتينا على رجل مستلق لقفاه، وإذا آخر قائم عليه بكلوب من حديد، وإذا هو يأتي أحد شقي وجهه فيشرشر شدقه إلى قفاه، ومنخره إلى قفاه، وعينه إلى قفاه ثم يتحول إلى الجانب الآخر فيفعل به مثل ما فعل بالجانب الأول، فما يفرغ من ذلك الجانب حتى يصح ذلك الجانب كما كان، ثم يعود عليه فيفعل مثل ما فعل في المرة الأولى.

রাত্রিকালে আমার নিকট দুইজন আগন্তুক এসে বললেন, চলুন। অতঃপর আমরা চলতে চলতে চিৎ হয়ে শায়িত এক ব্যক্তির নিকট পৌঁছলাম, আরেক ব্যক্তি তার কাছে লোহার হুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে শায়িত ব্যক্তির চেহারার একপার্শ্বে এসে চোয়াল, নাক ও চক্ষু হুক দ্বারা ঘাড়ের পিছনে টেনে নিয়ে যায়। অতঃপর অপর পার্শ্বে গিয়ে এমনটিই করে। অপর পার্শ্ব শেষ করার পূর্বেই প্রথম পার্শ্ব ঠিক হয়ে যায়। অতঃপর আগের মত আবার শুরু করে। নবিজি বলেন : আমি বললাম ‘‘সুবহানাল্লাহ’’ এরা দু’ জন কারা ? ফেরেশতারা বললেন : আমরা অচিরেই এদের সম্পর্কে আপনাকে বলব। শুনুন―যে ব্যক্তির চোয়াল, নাক ও চক্ষু টেনে উঠিয়ে ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়েছে, সে ব্যক্তি ঘর থেকে বের হয়ে একটি মিথ্যা কথা প্রচার করে দেয়। ফলে তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।[vi]

يشرشر শব্দের অর্থ يقطع অর্থাৎ টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলা।

মিথ্যার ভয়াল পরিণতি :

মিথ্যার খারাপ পরিণতি অনেক। তন্মধ্যে―

(১) মিথ্যা মুনাফেকদের খাসলত বা অভ্যাস।

(২) মিথ্যা যে ব্যক্তির অভ্যাসে পরিণত হয় আল্লাহর নিকট তার নাম মিথ্যাবাদীদের কাতারে লেখা হয়। এটি অত্যন্ত খারাপ দিক। কোন ব্যক্তি তার পরিবার অথবা সঙ্গীদের নিকট মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হতে চায় না। অতএব সে কীভাবে তার খালেকের নিকট এমনটি হতে চায় ?

(৩) মিথ্যাবাদীর সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য।

(৪) কখনো কখনো দেখা সে সত্য বললেও তা গ্রহণ করা হয় না। কেননা লোকজন তার কথার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ইবনে মুবারক রহ. বলেন : মিথ্যার সর্বপ্রথম শাস্তি হলো তার সত্য কথাও গ্রহণ না করা।

মিথ্যা থেকে নিষ্কৃতির উপায়

মিথ্যা থেকে মুক্তি লাভের অনেক পথ রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি উলে­খ করা হল:

(১) এহেন মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্যে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা।

(২) মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতির কথা চিন্তা করা।

(৩) আল্লাহ তাআলাকে পর্যবেক্ষক মনে করে এ কথা চিন্তা করা যে, তার ফেরেশতা বান্দাদের সবকিছু লিপিবদ্ধ করেন।

(৪) ভবিষ্যতে মিথ্যাবাদীর সর্বপ্রকার কথা ও কাজ অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করা। সাথে সাথে মানুষের নিকট হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার দিকটিও বিবেচনা করা।

(৫) একথা চিন্তা করা যে, প্রকৃত শান্তি ও মুক্তি একমাত্র সত্যের মাঝেই। চাই তা দুনিয়াতে হোক কিংবা আখেরাতে, যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে মিথ্যার মাঝে মুক্তি দেখা যায়।

(৬) মিথ্যার দিকে আহবানকারী সকল কাজ থেকে দূরে থাকা। সে কাজগুলো নিম্নরূপ : অশালীন কাজে জড়িয়ে পড়া, যা তাকে মিথ্যা বলে ওজর পেশ করতে বাধ্য করে। অধিক পরিমাণে অঙ্গীকার করা, যা তাকে অঙ্গীকার ভঙ্গ করার ব্যাপারে সাহায্য করবে। মিথ্যাবাদী বন্ধুদের সাথে উঠা-বসা করা। অথবা ঐ সকল লোকদের সাথে চলা যারা তাকে মিথ্যার প্রতি উৎসাহ দান করে অথবা তার মিথ্যা কথা শুনে।

আল্লাহ আমাদের সত্পথে ও সততার সাথে জীবন চালানোর তাওফিক দিন। সেই সাথে মিথ্যা পরিত্যাগ করার তাওফিক দিন। আমীন।

তথ্যসূত্র :

১. সূরা তাওবাহ আয়াত নং-১১৯

২. সূরা মুনাফিকুন।

৩. সূরা আরাফা, আয়াত নং-৩৩

৪. সূরা আন-নাহল আয়াত নং-১১৬

৫. বুখারী : ১২০৯

৬. বুখারী :  ৬৫২৫

(ইসলাম হাউজ পরিবেশিত প্রবন্ধ থেকে প্রকাশিত এবং ঈষত পরিবর্তিত)।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button