শাবান মাসঃ করণীয় ও বর্জণীয়

শাবান মাসঃ করণীয় ও বর্জণীয়

রচনায় :- আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী

হিজরী সনের ৮ম মাস হচ্ছে শাবান মাস। তার পরই আসে বছরের শ্রেষ্ঠ রামাযান মাস। সে হিসেবে মুসলিমের জীবনে এ মাসের যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে। দীর্ঘ এক মাস তাকে সিয়াম সাধনা করতে হবে। এর জন্য মানসিক, শারিরিক ও আর্থিক প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানের প্রস্তুতি স্বরূপ অন্য মাসের তুলনায় শাবান মাসে বেশী বেশী নফল রোযা রাখতেন।

আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَصُومُ حَتَّى نَقُولَ لاَ يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُولَ لاَ يَصُومُ فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلاَّ رَمَضَانَ وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِى شَعْبَانَ
আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রামাযন ব্যতীত অন্য কোন পূর্ণ মাস রোযা রাখতে দেখি নি। আর তাঁকে আমি শাবান মাসের চেয়ে অধিক নফল রোযা অন্য কোন মাসে রাখতে দেখিনি। (বুখারী) সুতরাং শাবান মাসে আমরাও রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী বেশী বেশী করে রাখবো এবং আল্লাহর কাছে প্রাণ খুলে দুআ করবো, তিনি যেন আমাদেরকে রামাযান পর্যন্ত হায়াত দান করেন এবং রামাযানের ফজীলত ও বরকত হাসিল করার তাওফীক দেন।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই শাবান মাস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। বিশেষ করে মধ্য শাবানের রাতে নফল নামায আদায় করা এবং পরের দিন সিয়াম পালন করার চিরাচরিত নিয়ম প্রচলিত আছে। যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই রাতের নফল নামায এবং দিনের বেলা রোযা রাখার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীছ পাওয়া যায়না। এ রাতকে আমাদের দেশের পরিভাষায় শবে বরাত বলা হয়ে থাকে। আসলে শবে বরাত নামে কুরআন, হাদীছ এমনকি ফিকহের কিতাবসমূহেও কোন রাত আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। এ রাত সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে সমস্ত বিদআতী বিশ্বাস ও আমল রয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ প্রয়োজন।

শবে বরাতে কুরআন নাযিল হয়েছে বলে ধারণাঃ

শবে বরাত পালনকারীদের বক্তব্য হল, শবে বরাতের রাতেই কুরআন নাযিল হয়েছে। সূরা দুখানের ৩নং আয়াতকে তারা দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে।

আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ (৩) فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
“আমি কুরআনুল কারীমকে একটি বরকতপূর্ণ রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ করা হয়। (সূরা দুখানঃ ৩-৪)

এ বরকতপূর্ণ রাতই হল শবে বরাতের রাত। কতিপয় আলেম এভাবেই অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন।
তাদের এ ব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়; বরং এখানে বরকতপূর্ণ রাত বলতে লাইলাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য। আল্লামা ইবনে কাছীর (রঃ) বলেন, অত্র বরকতপূর্ণ রাতই হল লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত। যেমন অন্যত্র সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য কথা হল, কুরআনের কোন অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা যদি অন্য কোন আয়াতে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়, তাহলে কুরআনের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করতে হবে। আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ সূরা কদরের শুরুতে বলেন,
إِنَّ أَنْزَلْنَاهُ فِى لَيْلَةِ الْقَدْرِ
“আমি কুরআনকে কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা কদরঃ ১)

আর এ কথা সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত যে, লাইলাতুল কদর রামাযান মাস ব্যতীত অন্য কোন মাসে নয়। আল্লাহ তায়ালা রামাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে সূরা বাকারায় বলেনঃ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِى أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْآنُ
“রামাযান মাস এমন একটি মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫)

সুতরাং শবে বরাতে কুরআন নাযিল হওয়ার কথা গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা।

শবে বরাতের রাতে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার ধারণাঃ

শবে বরাতের ইবাদতের পক্ষের আলেমগণ বলে থাকে, এ রাতের শেষের দিকে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। তারা দলীল হিসাবে নিম্নের হাদীছটিকে পেশ করে থাকেনঃ
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ فَقَدْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فَإِذَا هُوَ بِالْبَقِيعِ فَقَالَ ্র أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ গ্ধ. قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّى ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ فَقَالَ ্র إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ
উপরোক্ত অর্থ বহনকারী হাদীছটি কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সকল বর্ণনাই যঈফ বা দূর্বল। ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। ইমাম তিরিমিযী বলেনঃ আমি আমার উস্তাদ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারীকে বলতে শুনেছি যে, এই হাদীছটি যঈফ। দেখুন তিরমিযী, হাদীছ নং- ৭৪৪।

নির্দিষ্টভাবে এ রাতে আল্লাহর দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার এবং সকল বান্দাকে ক্ষমা চাওয়ার প্রতি আহবান জানানোর হাদীছটি সুনানের কিতাবে যঈফ ও জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে।
তা ছাড়া হাদীছটি বুখারীসহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত সহীহ হাদীছের বিরোধী।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ له
আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেনঃ কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি ক্ষমা করে দিব। অমুক আছে কি? অমুক আছে কি? এভাবে প্রতি রাতেই ঘোষণা করতে থাকেন। বুখারী, হাদীছ নং- ১০৯৪, মুসলিম, হাদীছ নং- ১৬৮।
সুতরাং জাল হাদীছের উপর ভিত্তি করে সহীহ হাদীছের মর্ম প্রত্যাখ্যান করে শবে বরাতের রাতে আল্লাহ্ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার আকীদা পোষণ করা এবং সে রাতে বিশেষ ইবাদত করা সম্পূর্ণ বিদআত।

মৃত ব্যক্তির রূহ দুনিয়াতে আগমণের বিশ্বাসঃ

শবে বরাত পালনের পিছনে যুক্তি হল, এ রাতে মানুষের মৃত আত্মীয়দের রূহসমূহ দুনিয়াতে আগমণ করে থাকে। তাই অনেকে এই রাতে মৃত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাতের জন্য দান-খয়রাত করে থাকে। এই জন্য এটি একটি অবান্তর ধারণা, যা কুরআন-সুন্নার সুস্পষ্ট বিরোধী। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَ مِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُوْنَ
“ওদের (মৃতদের) পিছনে রয়েছে অন্তরায়, তারা সেখানে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবস্থান করবে। (সূরা মুমেনূনঃ ১০০)

এ রাত্রে মানুষের ভাগ্য লিখা হয় বলে ধারণাঃ

যারা শবে বরাত পালন করে, তারা জোর দিয়ে বলে থাকেন, এটি হচ্ছে ভাগ্য রজনী। এ রাতে আগামী এক বছরে কারা মৃত্যু বরণ করবে, কারা জন্মগ্রহণ করবে, তাদের তালিকা করা হয় এবং কে কি রোজগার তাদের এ ধারণাটিও ঠিক নয়। এ কথার পিছনে কুরআন হাদীছের কোন দলীল নেই। সহীহ হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
كَتَبَ اللَّهُ مَقَادِيرَ الْخَلَائِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ
“আসমান-জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা স্বীয় মাখলুকের তাকদীর লিখে রেখেছেন। (সহীহ মুসলিম)

শবে বরাতের কতিপয় বিদআতী আমলঃ

হালুওয়া রুটি বিতরণঃ
শবে বরাতকে কেন্দ্র করে হালুওয়া-রুটির যে অনুষ্ঠান করা হয়, তাও বিদআত।

এ রাতে কবর যিয়ারতের পিছনে যুক্তি ও তা খন্ডনঃ

এ রাতে রাসূল (সাঃ) বাকী কবরস্থান যিয়ারত করেছেন। তাই আমাদেরকেও এ রাতে কবর যিয়ারত করতে হবে। এ মর্মে ইবনে মাজাহ শরীফে বর্ণিত হাদীছটি যঈফ। হাদীছের সনদে হাজ্জাজ বিন আরতাত নামক একজন যঈফ রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারী সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছ হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন।

একশত রাকাত নামাযের ভিত্তি খন্ডনঃ

এ রাতে একশত রাকাত নামাযের ব্যাপারে যত হাদীছ রয়েছে, তার সবই জাল বা বানোওয়াট। এ নামায সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদীছ নেই। হাফেয ইরাকী (রঃ) বলেনঃ নিসফে শাবানের রাতের নামায রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মিথ্যা রচনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
ইমাম নববী (রঃ) স্বীয় কিতাব মাজমুতে বলেনঃ মধ্য শাবানের রাত্রিতে সালাতুর রাগায়েব নামে যেই একশ রাকআত নামায পড়া হয়, তা বিদআত।
একশত রাকাত নামায পড়ার বিদআতটি ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়। ইমাম মাকদেসী (রঃ) বলেনঃ ৪৪৮ হিজরীতে বাইতুল মাকদিসে আমাদের নিকট ইবনে আবী হুমায়রা নামক একজন লোক আগমণ করল। তার তেলাওয়াত ছিল খুব সুন্দর। অর্ধ শাবানের রাতে সে মসজিদে আকসায় নামাযে দাঁড়িয়ে গেল। তার পিছনে একজন এসে দাঁড়াল। তারপর আরেকজন আসল। এভাবে এক, দুই তিন করে নামায শেষ করা পর্যন্ত বিরাট এক জামাতে পরিণত হল। পরবর্তীতে মসজিদের ইমামগণ অন্যান্য নামাযের ন্যায় এ নামাযও চালু করে দেয়। (দেখুনঃ الباعث على انكار البدع والحوادث ১২৪-১২৫)
বর্তমানে পাক-ভারত বাংলাদেশে এই নামাযকে শবে বরাতের নামায বলা হয়। শবে বরাত উপলক্ষে আমাদের দেশের রেডিও, টেলিভিশন, ওয়াজ মাহফিল ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে শবে বরাতের পক্ষে বিশেষ প্রচারণা চালনা হয় এমনকি ঐ দিন সরকারী ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়। এর পক্ষে ব্যাপক প্রচারণার ফলে সকল শ্রেণীর মানুষই শবে বরাত পালন করে থাকে। এমনকি যারা সারা বছর ফরজ নামায আদায় করেনা এমনকি জুমআর নামাযও আদায় করেনা তারাও শবে বরাতের নামায আদায় করে থাকে। ক্ষেত্রে বিশেষে এমনও দেখা যায় যে কোন মুসুল্লি সারা রাত শবে বরাতের নামায আদায় করার পর ঐ দিনের ফজরের নামাযও পড়ার গুরুত্ব অনুভব করেনা।
এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, আরব দেশসমূহে এর তৎপরতা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে ইসলামের প্রাণ কেন্দ্র সৌদি আরবে শবে বরাত পালনের কোন অস্তিত্বই দেখা যায়না। মক্কা-মদীনার সম্মানিত ইমামগণের কেউ কোন দিন শবে বরাত উদ্যাপন করার প্রতি জনগণকে উৎসাহিত করেন না। কারণ তারা ভাল করেই জানেন যে ইহা দ্বীনের কোন অংশ নয়; বরং তা একটি নব আবি®কৃত বিদআত। ইসলামে যদি এর কোন অস্থিত্ব থাকত, তাহলে পৃথিবীর সকল স্থানেই এটি পালিত হত। দলীল প্রমাণের মাধ্যমে যে বিষয়টি ইসলামের অন্তর্ভূক্ত বলে প্রমাণিত হবে, পৃথিবীর সকল স্থানেই তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। আর যেটি বিদআত হবে, তা কোথাও পাওয়া যাবে, আবার কোথাও পাওয়া যাবেনা এবং সব জায়গায় একই রূপে পাওয়া যাবেনা।

নিসফে শাবানের রাতের নামায সম্পর্কে বিন বায (রঃ)-এর একটি ফতোয়াঃ

আল্লামা আব্দুল আযীয বিন বায (রঃ)কে নিসফে শাবানের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল- এ রাতে বিশেষ কোন নামায আছে কি না?
উত্তরে তিনি বলেনঃ অর্ধ শাবানের রাত সম্পর্কে একটি সহীহ হাদীছও পাওয়া যায় নি। এ ব্যাপারে বর্ণিত সকল হাদীছ বানোয়াট ও যঈফ, যার কোন ভিত্তি নেই। আর এটি এমন রাত্রি, যার অতিরিক্ত কোন মর্যাদা নেই। তাতে কুরআন পাঠ, একাকী কিংবা জামাত বদ্ধ হয়ে কোন নামায আদায় করা যাবে না।
কতিপয় আলেম এই রাতের যে ফজীলতের কথা বলেছেন, তা দুর্বল। সুতরাং এ রাতের কোন অতিরিক্ত বৈশিষ্ট নেই। এটিই সঠিক কথা।
ইমাম আলবানী (রঃ) বলেনঃ অর্ধ শাবানের রাতের ফজীলতে অনেকগুলো দুর্বল হাদীছ এসেছে। সবগুলো হাদীছ এক সাথে মিলালে সহীহর স্তরে পৌঁছে যায়। (দেখুন সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১১৪৪)

তবে তিনি এ রাতে বিশেষ কোন এবাদত করাকে বিদআত বলে উল্লেখ করেছেন এবং কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছেন। (দেখুনঃ ইমাম আলবানীর ফতোয়া সিরিজ)

শবে বরাতের রোযাঃ

শবে বরাতের রোযা রাখার প্রমাণ স্বরূপ যে হাদীছটি পেশ করা হয়ে থাকে।
عن عَلِىِّ بْنِ أَبِى طَالِبٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ্র إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا يَوْمَهَا. فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ أَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ فَأَغْفِرَ لَهُ أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلاَ مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ أَلاَ كَذَا أَلاَ كَذَا حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ
ইমাম ইবনে মাজাহ এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এই হাদীছের সনদে ইবনে আবু সাব্রাহ নামক একজন জাল হাদীছ রচনাকারী রাবী থাকার কারণে হাদীছটি গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং হাদীছটি মাউযু বা সম্পূর্ণ বানোয়াট। (দেখুনঃ সিলসিলায়ে যাঈফা, হাদীছ নং- ২১৩২)
মুসলিম জাতির উচিৎ এ বিদআত থেকে বিরত থাকা। পরিতাপের বিষয় এই যে, অনেকেই এবিদআতকে বিদআতে হাসানাহ বলে থাকে। আসলে বিদআতে হাসানাহ বলতে কিছু নেই। ইসলামের নামে তৈরীকৃত সকল বিদআতই মন্দ, হাসানাহ বা ভাল বিদআত নামে কোন বিদআতের অস্তিত্ব নেই।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٍ وَ كُلُّ ضَلَالَةٍ فِى النَّارِ
“প্রতিটি বিদআতই ভ্রষ্টতা আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হল জাহান্নাম। (নাসাঈ)
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, “সমস্ত বিদআতই ভ্রষ্টতা যদিও মানুষ তাকে উত্তম বলে থাকে। (দেখুনঃالإبداع في بيان كمال الشرع وخطر الابتداع পৃষ্ঠা নং ২১-২১)
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দ্বীন। আল্লাহ্ তাআলা কুরআন ও হাদীছের মাধ্যমে এ দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا“
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের জন্য পূর্ণ করে দিলাম। এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদাঃ ৩)

আল্লাহ তআলা আরও বলেনঃ
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا“
তোমাদের রাসূল তোমাদেরকে যে বিষয়ের আদেশ করেন, তা তোমরা পালন কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক”। (সূরা হাশরঃ ৭)

আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (سورة آل عمران ৩১)
“বলোঃ যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভালবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ্ও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ্ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।” (সূরা আল-ইমরানঃ ৩১)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
تَركْتُ فيكُمْ أَمْرَيْنِ لنْ تَضِلُّوا ما تَمسَّكْتُمْ بهما كتابَ الله وسنّة رسولِهِ
আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি জিনষ রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা সে অনুযায়ী আমল করবে, ততদিন তোমাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং অন্যটি তাঁর রাসূলের সুন্নাত। (মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদীছ নং- ৬৪)

ইরাবায বিন সারিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ ্র أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ)
“একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে নামায পড়লেন। অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন। এতে আমাদের চক্ষু থেকে অশ্র ধারা প্রবাহিত হল এবং অন্তরসমূহ বিগলিত হল। তখন এক ব্যক্তি বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! সম্ভবতঃ এটিই বিদায়ী ভাষণ। সুতরাং আমাদেরকে আপনি কিসের উপদেশ দিচ্ছেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমি তোমাকে আল্লাহকে ভয় করার এবং আমীরের কথা শ্রবণ এবং তা মানার উপদেশ দিচ্ছি। আমীর যদিও একজন হাবশী গোলাম হয়। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা সে সময় আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তোমরা দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা”। (আবু দাউদ, ও তিরমিযী)
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: جَاءَ ثَلاثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ ، فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا، فَقَالُوا: وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِيِّ ؟ قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ، قَالَ أَحَدُهُمْ: أَمَّا أَنَا فَإِنِّي أُصَلِّي اللَّيْلَ أَبَدًا، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلا أُفْطِرُ، وَقَالَ آخَرُ: أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلا أَتَزَوَّجُ أَبَدًا. فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْهِمْ فَقَالَ: ্রأَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا؟ أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ، وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّيগ্ধ (بخارى:৫০৬৩)
আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেনঃ তিনজন লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্যে তাঁর স্ত্রীদের বাড়িতে আসলেন। তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হলে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলকে খুব কম মনে করল। তারা বললেনঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমান হতে পারবো? কেননা তাঁর পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তাদের একজন বললেনঃ আমি সারা জীবন রাতের বেলা নামায আদায় করবো। আরেকজন বললেনঃ আমি সারা জীবন রোজা রাখবো। কখনই রোজা ছাড়বো না। অন্যজন বললঃ আমি স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকবো। কখনই তাদের সাথে মিলিত হবো না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কথা শুনার পর তাদের কাছে গিয়ে বললেনঃ তোমরা কি এরূপ এরূপ কথা বলো নি? আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের তুলনায় আল্লাহ্কে অধিক ভয় করি। কিন্তু আমি রোজা রাখি, রোজা থেকে বিরত থাকি, নামায পড়ি, নিদ্রা যাই আবার স্ত্রীদের সাথেও মিলিত হই। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হতে বিমুখ হবে, সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভূক্ত নয়। (বুখারী)

উপসংহারঃ

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, শবেবরাত নামে কোন রাত নেই। মধ্য শাবানের রাতে আলাদা কোন এবাদত নেই। সুতরাং মুসলিমদের উচিত, দ্বীনের ক্ষেত্রে সকল বিদআত পরিহার করে কুরআন ও সহীহ হাদীছ মুতাবেক তাদের সকল আমল সংশোধন করে নেওয়া। আল্লাহই তাওফীক দানকারী।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
kiw kow kan