ইসরা ও মেরাজ : কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

ইসরা অর্থাৎ রাতের কিছু অংশে পবিত্র কাবা হতে ভূ-মধ্য সাগরের পূর্ব তীর ফিলিস্তিনে অবস্থিত পবিত্র বায়তুল মাকদিস এবং সেখান থেকে মেরাজ : অর্থাৎ সপ্তম আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন ও ধনুক কিংবা তার চেয়ে কম দূরত্ব পরিমাণ আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য পর্যন্ত ভ্রমণ। এ নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার মহান কুদরত, অলৌকিক নিদর্শন, নবুয়তের সত্যতার স্বপক্ষে একটি বিরাট আলামত, জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ, সত্যাজ্ঞাপনকারী মোমিনদের জন্য একটি প্রমাণ, হেদায়েত, নেয়ামত ও রহমত।

রাসূল সা.-এর সহধর্মিণী উম্মে হানী বলেন, ইসরার শুভরাত্রিতে রাসূল সা. আমার ঘরে, আমার কাছে, এশার নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন, আমরাও তার সাথে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে ফজরের কিছুক্ষণ আগে আমাদের তিনি জাগ্রত করেন, নামাজ পড়েন, আমরাও তার সাথে নামাজ আদায় করি। অতঃপর তিনি বলেন উম্মি হানি, তুমি লক্ষ্য করেছ, এখানেই আমরা একসাথে এশার নামাজ পড়েছি, এরপর আমি বায়তুল মাকদিস গিয়েছি, সেখান থেকে ফিরে এসে এই মাত্র তোমাদের সাথে ফজর নামাজ আদায় করলাম, যা লক্ষ্য করছ। হাসান রহ.-এর বর্ণনায় আছে, রাসূল সা. বলেন, আমি হিজরতে হাতিম (কাবার বহিরংশ, একে হিজরে ইসমাইলও বলা হয়) ঘুমিয়ে ছিলাম। এমতাবস্থায় জিবরিল আ. আসেন, আমাকে পায়ে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন, আমি উঠে বসি, কিন্তু কাউকে না দেখে পুনরায় শুয়ে পড়ি। তৃতীয় বার সে আমার বাহু ধরে, আমি তার সাথে দাঁড়িয়ে যাই। অতঃপর আমাকে মসজিদের দরজার কাছে নিয়ে আসে, সেখানে লক্ষ্য করি, অদ্ভুত আকৃতির একট প্রাণী, যাকে গাধাও বলা যায় না আবার তা ঘোড়ার মতও না। উরুতে বিশাল আকার দুটি পাখা, যার মাধ্যমে সে পায়ে আঘাত করে। চোখের দৃষ্টিসীমার প্রান্তে গিয়ে তার সম্মুখ পা দুটি মাটি স্পর্শ করে। এর নাম বোরাক। আগের যুগের নবিগণ এর উপরেই আরোহণ করতেন। আমাকে তার উপর আরোহণ করাল। জিবরিল আমিনের সাহচর্যে আমি আসমান-জমিনের বিচিত্র নিদর্শন দেখতে দেখতে বায়তুল মাকদিসে পৌঁছি। সেখানে অবতরণ করে জিবরিল দরজার আংটার সাথে বোরাক বাঁধেন, আমি লক্ষ্য করি, ইবরাহিম, মুসা ও ইসা আ.দের সাথে আরো অনেক নবিগণ একত্রিত হয়েছেন সেখানে। মুসা আ. এর আকৃতি একটি উপমাযোগ্য দেহের ন্যায়। শানুয়া বংশের পুরুষদের মত অনেকটা। কোঁকড়ানো চুল, হালকা গড়ন, লম্বা শরীর। ইসা আ. এর আকৃতি মাঝারি গড়ন, ঝুলন্ত সোজা চুল, চেহারা সৌন্দর্য তিলকে ভর্তি। মনে হচ্ছিল
তিনি গোসলখানা হতে বের হয়েছেন, পানি টপকাচ্ছে মাথা হতে, অথচ কোন পানি টপকাচ্ছিল না। প্রায় উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফির মত। ইবরাহিমের আকৃতি আমার মত, আমি-ই তার সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। অত:পর আমার সামনে দুটি পেয়ালা : একটি মদের অপরটি দুধের, পেশ করা হয়। আমাকে বলা হল : যেটা ইচ্ছে পান
করেন, আমি দুধের পেয়ালা হাতে নেই এবং পান করি। আমাকে বলা হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যদি আপনি মদের পেয়ালা হাতে নিতেন, পান করতেন, আপনার উম্মত গোমরাহ হয়ে যেত। অপর একটি বর্ণনায় পানির তৃতীয় আরেকটি পেয়ালার উল্লেখও পাওয়া যায়। (দ্র : ইবনে হিশাম, বোখারি, মুসলিম)
অতঃপর তিনি প্রথম আসমানে আরোহণ করেন, রাসূলের জন্য দরজা খুলতে বলা হয়, দরজা খুলে দেয়া হয়। সেখানে আদম আ. এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। তার ডান পাশে জান্নাতিদের রুহ এবং বাম পাশে জাহান্নামিদের রুহ প্রত্যক্ষ করেন। অতঃপর দ্বিতীয় আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইয়াহইয়া ইবনে জাকারিয়া ও তার খালাতো ভাই ইসা ইবনে মারইয়ামের সাথে সাক্ষাৎ হয়। অত:পর তৃতীয় আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইউসূফ আ. এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর চতুর্থ আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইদরিস আ. এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। অতঃপর পঞ্চম আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে মূসা আ. এর ভাই হারুন ইবনে ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ হয়। অত:পর ষষ্ঠ আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে মূসা ইবনে ইমরানের সাথে সাক্ষাৎ হয়। রাসূল তার থেকে বিদায় নিলে তিনি কেঁদে ফেলেন। জিজ্ঞাসা করা হল, কি জন্য কাঁদেন ? তিনি বলেন, এ জন্য কাঁদি, আমার পরে একজন যুবক প্রেরণ করা হয়েছে, তার উম্মত আমার উম্মতের চেয়ে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতঃপর সপ্তম আসমানে আরোহণ করেন, সেখানে ইবরাহিম আ. এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। সকলেই তাকে অভিবাদন, স্বাগত, অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন, তার নবুওয়তের স্বীকারোক্তি প্রদান করেন। অতঃপর সর্বশেষ সীমা : সিদরাতুল মুন্তাহায় পৌঁছেন, যার ফল হাজার শহরের কলসির ন্যায়, পাতা হাতির কানের মত, যা স্বর্ণের পতঙ্গ, আলোকোজ্জ্বল, বিচিত্র রং বেষ্টিত। যে সৌন্দর্য বর্ণনা করার সাধ্য কারো নেই। অতঃপর বায়তুল মামুরে আরোহণ করেন, যেখানে প্রতি দিন সত্তুর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে, যাদের কেউই কিয়ামতের পূর্বে পুনরায় প্রবেশ করার সুযোগ পাবে না। অতঃপর জান্নাতে প্রবেশ করেন, যার ভেতর স্বর্ণের রশি, কস্তুরীর মাটি প্রত্যক্ষ করেন। অতঃপর আরো উপরে উঠে কলমের আওয়াজ শুনতে পান। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী হন, ধনুক বা তার চেয়ে কম দূরত্বের ব্যবধানে। অতঃপর তার প্রতি, যা ইচ্ছে ছিল, ওহি করেন। পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। ফেরার পথে মূসা আ. এর পরামর্শে পুনরায় আল্লাহর দরবারে পুনঃ পুনঃ গিয়ে শেষাবধি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসেন। দূরে এসে একটি ঘোষণা শুনতে পান- আমার ধার্যকৃত নিশ্চিত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছি, আমার বান্দার জন্য সহজ করে দিয়েছি। (দ্র : যাদুল মায়াদ ২ : ৪৭ ও ৪৮, রহিকুল মাখতুম: পৃ: ১৬০, ইবনে হিশাম:১/২৪২-২৪৬)

কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত, এ সফরের প্রাক্কালে তার বক্ষ মোবারক জমজমের পানি দ্বারা বিধৌত করে নূর ও প্রজ্ঞায় পূর্ণ করা হয়। এ সফরে আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটে : সিদরাতুল মুনতাহার নিকট চারটি নহর প্রবাহিত হতে দেখেন। দুটি দৃশ্য, যা নিল ও ফুরাত নদীর উৎস ; দুটি অদৃশ্য, যা জান্নাতে প্রবাহিত হচ্ছে। নিল ও ফুরাত নদীর অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন এ দুটি অঞ্চলে ইসলামের অবস্থান দৃঢ় ও শক্ত হবে। জাহান্নামের ফেরেশতা প্রত্যক্ষ করেন : সে হাসে না। তার চেহারায় কোন সৌহার্দ্য বা কোমলতা নেই। তদ্রুপ, জান্নাত-জাহান্নামও প্রত্যক্ষ করেন। এতিমদের সম্পদ ভক্ষণকারীদের প্রত্যক্ষ করেন : উটের ঠোঁটের ন্যায় বিশাল চোয়াল বিশিষ্ট, যাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, পরক্ষণই যা পিছনের রাস্তা দিয়ে বের হচ্ছে। সুদখোরদের দেখেন : বিশাল ভুড়ি বিশিষ্ট, যার কারণে তারা নড়াচড়া করতে পারছিল না, ফেরআউনের বংশধর তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, আর দলিত করছে। যিনাকারদের দেখেন : তাদের সামনে ভাল-সুস্বাদু গোস্ত বিদ্যমান, অথচ তারা দুর্গন্ধময়, পচা গোস্ত খাচ্ছে। বেশ্যা নারীদের দেখেন : স্তন ঝুলন্ত। মক্কা হতে একটি কাফেলা যেতে, আরেকটি কাফেলা আসতে দেখেন। তাদের একটি হারানো উটের সন্ধান দেন। তাদের ঢাকনা আবৃত একটি পাত্র হতে পানি পান করেন, অতঃপর তা ঢেকে রাখেন। যা ইসরা ও মেরাজের সুস্পষ্ট, বাহ্যিক দলিল প্রমাণিত হয়। (যাদুল মায়াদ, ইবনে হিশাম, রহিকুল মাখতুম পৃ: ১৬১)
সকালে যখন তিনি এ ঘটনার বিবরণ দেন, চারদিক হতে অলীক ও মিথ্যার অপবাদ আসতে থাকে, সকলে বায়তুল মাকদিসের অবকাঠামো জানতে চান। আল্লাহ তার সামনে বায়তুল মাকদিসের চিত্র তুলে ধরেন, তিনি সবিস্তারে এক-একটি করে বর্ণনা প্রদান করেন, যা প্রত্যাখ্যান করার সাধ্য কারো ছিল না।

জাবের রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা-কে তিনি বলতে শুনেন, যখন কুরাইশগণ আমাকে মিথ্যারোপ করল, আমি হিজরে দণ্ডায়মান হই, আল্লাহ আমার জন্য বায়তুল মাকদিসের চিত্র তুলে ধরেন, আমি দেখে দেখে তাদের জিজ্ঞাসিত তথ্য জানিয়ে দেই। (বোখারি হা.৪৭১০, মুসলিম হা.১৭০)
পথে সাক্ষাৎপ্রাপ্ত কাফেলার সংবাদও দেন, তাদের আসার নির্ভুল তারিখও বলেন, তাদের হারানো উটের সন্ধান দানের কথাও বলেন, যার সত্যাসত্য প্রমাণও তারা পেয়েছে। তবুও তাদের বিরোধিতা আর প্রত্যাখ্যান-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। (দ্র : যাদুল মায়াদ, বোখারি, মুসলিম, ইবনে হিশাম) চতুর্মুখি বিরোধিতা সত্ত্বেও আবু বকর নির্দ্বিধায় সত্যারোপ করে সিদ্দিক উপাধি প্রাপ্ত হন। (ইবনে হিশাম)

কি জন্য এ মেরাজ? আল্লাহ বলেন, আমরা তাকে বড় বড় কিছু নিদর্শন দেখানোর ইচ্ছা করছি। রিসালাত ও নবুয়তের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত বান্দাদের ব্যাপারে এটাই মহান আল্লাহর নীতি ও বিধান। যেমনটি হয়েছে ইবরাহিম আ., মূসা আ. ও অন্যান্য নবি-রাসূলদের ব্যাপারে। যাতে তাদের চাক্ষুষ ইমান লাভ হয়, আল্লাহর রাস্তায় যে কোন ত্যাগ, কুরবানি অম্লান বদনে পেশ করতে পারেন। আরো বহু হিকমত ! অনেক শিক্ষা নিহিত এ ইসরা ও মেরাজের মাঝে।

নিশ্চিত রাসূল সা.- এর নবুয়ত ও তার শ্রেষ্ঠত্বের একটি বড় প্রমাণ ইসরা ও মেরাজ। আল্লাহ তাআলার মহান কুদরত। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হচ্ছে –

তিনি পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চতুর্দিকে আমি বরকতময়তার বিস্তার করেছি, তাকে আমার নিদর্শন হতে প্রদর্শনের জন্য। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্ট। (বনী ইসরাইল-১)

মেরাজ রজনির তারিখ :

মেরাজের রাত নিরূপণে অনেক মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে
১. নবুয়তের প্রথম বৎসর।
২. নবুয়তের পঞ্চম বৎসর ইমাম নববী ও কুরতুবী এ মতটি গ্রহণ করেছেন।
৩. রজবের ২৭ তারিখ নবুয়তের দশম বৎসর।
৪. হিজরতের ১৬ মাস আগে, অর্থাৎ নবুয়তের ১২ম বৎসর, রমজানে।
৫. হিজরতের এক বৎসর দুই মাস আগে, অর্থাৎ নবুয়তের ১৩ম বৎসর, মহররমে।
৬. হিজরতের এক বৎসর আগে, অর্থাৎ নবুয়তের ১৩ বৎসর, রবিউল আউয়ালে। প্রথম তিনটি অভিমত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ, খাদিজা নবুয়তের দশম বৎসর রমজান মাসে
ইন্তেকাল করেন। এদিকে সবার নিকট স্বীকৃত, তার মৃত্যুর পর নামাজ ফরজ হয়। সে হিসেবে রজবের ২৭ তারিখে মেরাজ হতে পারে না। অন্য বর্ণনার স্বপক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য কোন দলিল নেই। যতটা বুঝে আসে, ইসরা ও মেরাজ অনেক পরে সংঘটিত হয়েছে। (রহিকুল মাখতুম পৃ : ১৬০)

যদিও এ রাত নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হত, তবুও এতে বিশেষ কোন এবাদত করা বৈধ হত না। কারণ, নবী সা. ও তার সাহাবাবৃন্দ এ রাতে কোন মাহফিল উদ্‌যাপন, কবর জিয়ারত, সমবেত হয়ে কোন এবাদত সম্পাদন বা নির্ধারণ করেননি। যদি এতে এ জাতীয় আমলের কোন বিশেষত্ব থাকত, রাসূল সা. উম্মতকে অবশ্যই বাতলে দিতেন, অথবা কাজে-কর্মে বাস্তবায়ন করতেন। আর তার থেকে কোন জিনিস প্রকাশ পেলে অন্তরঙ্গ স্ত্রী, কিংবা সার্বক্ষণিক সমবিভ্যাহারে সঙ্গীদের নিকট জানাজানি হত। তারা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছাত। কারণ, তারা কোন ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই প্রতিটি জিনিস আমাদের পর্যন্ত পৌঁছিয়ে গেছেন। অধিকন্তু তারা আমাদের তুলনায় সওয়াবের অধিক লোলুপ, লুব্ধ ছিলেন। যদি শরিয়তে এর বৈধতা বিদ্যমান থাকত, আমাদের আগেই তারা আমল করে নিতেন। রাসূল সা. যথার্থভাবে নবুয়ত পৌঁছিয়েছেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ অর্পিত দায়িত্ব আদায় করেছেন, যদি এ রাতকে সম্মান প্রদর্শন করা, এ রাতে কোন মাহফিলের আয়োজন করা বা কবর জিয়ারত করা ইসলামের অংশ হত, রাসূল এতে শৈথিল্য প্রদর্শন করতেন না, আমাদের থেকে গোপন রাখতেন না। যখন এর একটিও রাসূল সা. থেকে বিদ্যমান নেই আমরা নিশ্চিত, এ রাতকে সম্মান প্রদর্শন বা এ রাতে মাহফিল করা, কবর জিয়ারত করা ইসলামের কোন অংশ নয়। আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন, অধিকন্তু যে এর ভেতর কোন নতুন আবিষ্কার করবে, তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে –

আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (মায়েদা-৩)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা একে স্বীয় ধর্মে অনধিকার চর্চা ও তার বিপরীতে অন্য ধর্ম প্রণয়ন অভিহিত করেছেন, এরশাদ হচ্ছে –

আল্লাহর সমকক্ষ তাদের কি শরিক দেবতা আছে ? যারা তাদের জন্য আল্লাহকে পাশ কাটিয়ে এমন ধর্ম সিদ্ধ করেছে, যার অনুমতি তিনি দেননি ? যদি পূর্ব হতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না থাকত, তাদের ব্যাপারে এখন-ই ফয়সালা হয়ে যেত। নিশ্চয় জালিমদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (শুরা-২১)
সহি বিশুদ্ধ হাদিসে প্রমাণিত, রাসূল সা. দ্বীনের ভেতর নব-আবিষ্কার তথা বেদআত হতে সতর্ক করেছেন। স্পষ্ট বলেছেন বেদআত গোমরাহি। যাতে উম্মত এর ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে, এর থেকে বিরত থাকে। যেমন, জাবের রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন –
চির সত্য, শাশ্বত বাণী আল্লাহর কিতাব, চির সুন্দর নান্দনিক আদর্শ মোহাম্মদ সা.-এর আদর্শ। অতি ঘৃণিত ও নিন্দিত নব আবিষ্কৃত বিষয়-আশয়, প্রত্যেক নতুন আবিষ্কৃত বস্তুই বেদআত, প্রত্যেক বেদআত গোমরাহি। (আহমদ হা. ১৩৯২৪, মুসলিম হা. ৮৬৭, নাসায়ী হা. ১৫৭৮, ইবনে মাজাহ ৪৫) অন্য বর্ণনায় আছে, প্রত্যেক বেদআতের স্থান
জাহান্নাম। (নাসায়ী আল-কুবরা ১৭৮৬, ৫৮৯২, আল-মুজতাবা ১৫৭৮, বায়হাকি ২২৯, সহি আল-জামে ১৩৫৩)
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন – যে আমাদের এ ধর্মে নতুন কোন আবিষ্কার করল, তা পরিত্যক্ত। (বোখারি হা. ২৬৯৭, মুসলিম হা. ১৭১৮)

মুসলিমের আরেক বর্ণনায় আছে, যে এমন আমল সম্পাদন করল, যার নমুনা আমাদের ভেতর নেই, তা পরিত্যক্ত। (মুসলিম হা.১৭১৮, আহমদ হা.২৬৯৭) মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় জাবের হতে বর্ণিত, রাসূল সা. চিরবিদায় গ্রহণকারী ব্যক্তির ন্যায়, নসিহত করেন, যে নসিহত শুনে চক্ষু অশ্রু জড়িয়েছে, অন্তর বিগলিত হয়েছে,… খবরদার ! নব আবিষ্কৃত আমল তথা বেদআত হতে বিরত থাক। কারণ, প্রত্যেক বেদআত গোমরাহি। (মুসলিম) প্রত্যেক গোমরাহির পরিণাম জাহান্নাম। (নাসায়ী)

সাহাবায়ে কেরাম, আদর্শ পূর্বসূরীগণ বেদআত হতে সতর্ক করেছেন, দুরে থাকতে বলেছেন। কারণ, বেদআত মানে আল্লাহর উপর অপবাদ দেয়া। নবুয়তের প্রতি খেয়ানতের অঙ্গুলি প্রদর্শন করা। সাহাবাদের আদালত তথা বিশ্বস্ততা প্রশ্নবিদ্ধ করা। এবাদতের আকৃতিতে কবিরা বা সগিরা গুনাহে লিপ্ত হওয়া। মুসলিম উম্মাহর ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করা। শরিয়তের বিরুদ্ধাচরণ তথা দ্বীনের ভেতর বৃদ্ধি করা ও বিলুপ্ত করা। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তার দ্বীনে অনধিকার চর্চা করা। ইয়াহুদ, নাসারাদের সাথে সামঞ্জস্য এখতিয়ার করা, তারাও নিজেদের দ্বীনের ভেতর এভাবে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন করেছে। বেদআতের আবিষ্কার মানে দ্বীনের ভেতর ত্রুটি স্বীকার করা, দ্বীন অসম্পূর্ণতার সাক্ষ্য প্রদান করা। যা সরাসরি আল্লাহর বাণী-
আজ আমি তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। (মায়েদা:৩)-এর সাথে সাংঘর্ষিক। রাসূল সা. হতে বর্ণিত সহি হাদিস সমূহের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া বলেন, সুন্নতের পক্ষাবলম্বন করা, বেদআতের বিরুদ্ধাচরণ করা জেহাদের চেয়েও উত্তম। (মাজমুউল ফতওয়া ৪:১৩)
কোরআন-হাদিস যে সব বিষয় ঊহ্য রেখেছে, পরবর্তী যুগে সাহাবায়ে কেরাম যা উদ্‌ঘাটন করেননি, তা আমাদের গবেষণার বিষয় নয়। বরং গবেষণার বিষয় ও লক্ষ্য : তার আনীত কোরআন, তার হায়াতে কথা-কর্মে প্রদর্শিত আদর্শ। তিনি বলেছেন, যত দিন তোমরা কোরআন, আমার সুনড়বত আঁকড়ে থাকবে, পথ ভ্রষ্ট হবে না। তাই আমাদের মূলকাজ মেরাজের রাত নিরূপণ নয়, এর বিশেষ এবাদত আবিষ্কারও নয়। বরং এ রাতে রাসূল সা.-কে প্রদানকৃত এবাদত, কুফর-শিরকের মাঝখানে পার্থক্যকারী শাশ্বত নামাজই উদ্দেশ্য, কাম্য। তার প্রতিই যত্নবান হওয়া, তার মহত্ত্বের কথা চিন্তা করা, তার মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্যের স্বাদ উপভোগ করা।
আল্লাহ তুমি আমাদের সৎ পথ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

১টি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88