” لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ ” এর ব্যাকরণগত আলোচনা, এর স্তম্ভ ও শর্তসমূহ
” لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ ” এর ব্যাকরণগত আলোচনা, এর স্তম্ভ ও শর্তসমূহ
এ কালেমার ব্যাকরণগত আলোচনা:
যেহেতু অনেক বাক্যের অর্থ বুঝা নির্ভর করে তার ব্যকরণগত আলোচনার উপর, সেহেতু ওলামায়ে কেরাম
“لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ” এই বাক্যের ব্যকরণগত আলোচনার প্রতি তাঁদের দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন এবং তারা বলেছেন যে, এই বাক্যে
“لا”
শব্দটি ‘নাফিয়া লিল জিনস’ (সমগোত্রীয় অর্থ নিষিদ্ধকারী নিষেধসূচক বাক্য) এবং
إِله (ইলাহ) শব্দটি এর ইসম (উদ্দেশ্য), মাবনি আলাল ফাতহ্ (যা সর্বাবস্থায় ফাতহ বা যবর বিশিষ্ট হয়)। আর এর খবরটি এখানে উহ্য, যা হচ্ছে
حق শব্দটি। অর্থাৎ কোনো হক বা সত্য ইলাহ নেই।
إِلاَّ اللهُ হচ্ছে খবর, (বিধেয়) যা মারফু (পেশ হওয়ার স্থানে; কারণ তা)
“حق” শব্দ হতে ইসতেসনা বা ভিন্নতর। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত হক বা সত্য ইলাহ বলতে কেউ নেই। ‘
“إِلهَ”
শব্দের অর্থ ‘‘মা‘বুদ’’ আর তিনি হচ্ছেন ঐ সত্তা যে সত্তার প্রতি কল্যাণের আশায় এবং অকল্যান থেকে বাঁচার জন্য হৃদয়ের আসক্তি সৃষ্টি হয় এবং মন তার উপাসনা করে।
এখানে কেউ যদি মনে করে যে, উক্ত খবরটি হচ্ছে ‘‘মাউজুদুন’’ বা ‘‘মা‘বুদুন’’ অথবা এ ধরনের কোনো শব্দ তা হলে এটা হবে অত্যন্ত ভুল। কারণ বাস্তব তো এই যে, আল্লাহ ব্যতীত অনেক মা‘বুদ বিদ্যমান রয়েছে যেমন মূর্তি, মাজার ইত্যাদি। তবে আল্লাহ হচ্ছে সত্য মাবুদ, আর তিনি ব্যতীত অন্য যত মা‘বুদ রয়েছে বা অন্য যেগুলোর ইবাদত করা হয় তা হচ্ছে অসত্য ও ভ্রান্ত। আর এটাই হচ্ছে
” لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ ”
এর না বাচক ও হাঁ বাচক এ দুই স্তম্ভের মূল দাবী।
• لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এই কালেমার রুকনসমূহ:
এ কালেমার রয়েছে দুটি স্তম্ভ বা রুকন। তন্মধ্যে প্রথম রুকন হচ্ছে না বাচক আর অপরটি হলো হাঁ বাচক।
না বাচক কথাটির অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত কিছুর ইবাদতকে অস্বীকার করা, আর হাঁ সূচক কথাটির অর্থ হচ্ছে একমাত্র আল্লাহই সত্য মা‘বুদ। আর মুশরিকগণ আল্লাহ ব্যতীত যেসব মা‘বুদের উপাসনা করে সবগুলো মিথ্যা এবং বানোয়াট মা‘বুদ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ٦٢ ﴾
[الحج: ٦٢]
“এটা এ জন্য যে, আল্লাহ-ই প্রকৃত সত্য, আর তিনি ব্যতীত যাদেরকে তারা ডাকে সে সব কিছুই বাতিল। (আল্ হাজ্ব-৬২)
ইমাম ইবনুল কাইয়েম বলেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা ইলাহ বা মাবুদ’’ এ কথার চেয়ে ‘‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই’’ এই বাক্যটি আল্লাহর উলুহিয়াত প্রতিষ্ঠার জন্য অধিকতর মজবুত দলিল; কেননা ‘‘আল্লাহ ইলাহ’’ একথা দ্বারা অন্যসব যত ভ্রান্ত ইলাহ রয়েছে তাদের ইলাহ বা মা‘বুদ হওয়াকে অস্বীকার করা হয় না। আর ‘‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’’ এ কথাটি উলুহিয়্যাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং অন্য সকল বাতিল ইলাহকে অস্বীকার করে। কিছু লোক চরম ভুলবশতঃ বলে থাকে যে, ‘‘ইলাহ’’ শব্দের অর্থ “সৃষ্টি করার ক্ষমতার অধিকারী।”
শাইখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ তাঁর কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘‘ইলাহ এবং উলুহিয়্যাতের’’ অর্থ তো স্পষ্ট হলো, (অর্থাৎ তা হচ্ছে মা‘বুদ বা উপাস্য) কিন্তু কেউ যদি বলে যে, “ইলাহ” শব্দের অর্থ হচ্ছে, সৃষ্টি করার ক্ষমতার অধিকারী” বা অনুরূপ কোনো কথা, তখন তার উত্তরে কী বলা হবে?
মূলতঃ এই প্রশ্নের উত্তরের দুটি পর্যায় রয়েছে,
প্রথমতঃ এটা একটা উদ্ভট, অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। এ ধরনের কথা বিদ‘আতী ব্যক্তিরাই বলে থাকে, কোনো বিজ্ঞ আলেম বা আরবী ভাষাবিদগণ ‘‘ইলাহ’’ শব্দের এ ধরনের অর্থ করেছেন বলে কেউ বলতে পারবে না বরং তাঁরা এ শব্দের ঐ অর্থই করেছেন যা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি (দেখুন, লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ এর রুকন বর্ণনায়। )। অতএব, এখানেই এ ধরনের ব্যাখ্যা ভুল বলে প্রমাণিত হলো।
দ্বিতীয়ঃ ক্ষনিকের জন্য এ অর্থকে মেনে নিলেও এমনিতেই ‘‘সত্য ইলাহ’’ যিনি হবেন তাঁর জন্য সৃষ্টি করার গুণাবলি একান্তই অপরিহার্য, অতএব ‘‘ইলাহ’’ হওয়ার জন্য সৃষ্টি করার সার্বিক যোগ্যতা থাকা তো অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই তার সাথে জড়িত, আর যে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে অক্ষম সে তো ‘‘ইলাহ’’ হতে পারে না, যদিও তাকে ইলাহ রূপে কেউ অভিহিত করে থাকুক না কেন। সুতরাং কেউ যদি ‘ইলাহ’ দ্বারা ‘সৃষ্টি করতে সমর্থ’ এটা বুঝে থাকেন তবে মনে করতে হবে তিনি এটাই উদ্দেশ্য নিচ্ছেন যে যিনি ইলাহ বা মা‘বুদ হবেন তাঁর মধ্যে এ বাধ্যতামূলক ক্ষমতাটি থাকতে হবে। তাঁর উদ্দেশ্য এটা নয় যে, ‘ইলাহ’ বলতে ‘নতুন করে সৃষ্টি করতে সমর্থ’ এটুকু বিশ্বাসের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির ইসলামের গণ্ডিতে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট হবে অথবা এতটুকু কথা কিয়ামতের দিন জান্নাত লাভের জন্যও যথেষ্ট হবে। যদি এতটুকু বিশ্বাসই যথেষ্ট হতো তাহলে আরবের কাফিররাও মুসলিম বলে গণ্য হতো। তাই এ যুগের কোনো লেখক যদি ‘‘ইলাহ’’ শব্দের এ অর্থই করে থাকেন তা হলে তাকে ভ্রান্ত বলতে হবে এবং কুরআন হাদীসের জ্ঞানগর্ভ দলিল দ্বারা এর প্রতিবাদ করা একান্ত প্রয়োজন। (তাইসীরুল আযীযিল হামীদ পৃ. ৮০। )
• لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ এর শর্তসমূহঃ
এই পবিত্র কালেমা মুখে বলাতে কোনই উপকারে আসবে না যে পর্যন্ত এর সাতটি (কোনো কোনো আলেম এর সাথে অষ্টম শর্ত যোগ করেছেন, আর তা হচ্ছে, তাগুতের সাথে কুফরী। ) শর্ত পূর্ণ করা না হবে।
প্রথম শর্ত: এ কালেমার না বাচক এবং হাঁ বাচক দুটি অংশের অর্থ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থ এবং উদ্দেশ্য না বুঝে শুধুমাত্র মুখে এ কালেমা উচ্চারণ করার মধ্যে কোনো লাভ নেই। কেননা সে ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি এ কালেমার মর্মের উপর ঈমান আনতে পারবে না। আর তখন এ ব্যক্তির উদাহরণ হবে ঐ লোকের মত যে লোক এমন এক অপরিচিত ভাষায় কথা বলা শুরু করল যে ভাষা সম্পর্কে তার সামান্যতম জ্ঞান ও নেই।
দ্বিতীয় শর্ত: ইয়াকীন বা দৃঢ় প্রত্যয়। অর্থাৎ এ কালেমার মাধ্যমে যে কথার স্বীকৃতি দান করা হলো তাতে সামান্যতম সন্ধেহ পোষণ করা চলবে না।
তৃতীয় শর্ত: ঐ ইখলাছ বা নিষ্ঠা, যা
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এর দাবী অনুযায়ী ঐ ব্যক্তিকে শির্ক থেকে মুক্ত রাখবে।
চতুর্থ শর্ত: এই কালেমা পাঠকারীকে সত্যের পরাকাষ্ঠা হতে হবে, যে সত্য তাকে মুনাফিকী আচরণ থেকে বিরত রাখবে। মুনাফিকরাও
لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ
এ কালেমা মুখে মুখে উচ্চারণ করে থাকে, কিন্তু এর নিগূঢ় তত্ত্ব ও প্রকৃত অর্থে তারা বিশ্বাসী নয়।
পঞ্চম শর্ত: ভালবাসা। অর্থাৎ মোনাফেকী আচরণ বাদ দিয়ে এই কালেমাকে সানন্দচিত্তে গ্রহণ করতে হবে ও ভালবাসতে হবে।
ষষ্ট শর্ত: আনুগত্য করা। এই কালেমার দাবী অনুযায়ী তার হকগুলো আদায় করা, আর তা হচ্ছে আল্লাহর জন্য নিষ্ঠা ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ফরয ওয়াজিব কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়া।
সপ্তম শর্ত: আন্তরিক ভাবে এ কালেমাকে কবুল করা এবং এর পর দ্বীনের কোনো কাজকে প্রত্যাখান করা থেকে নিজকে বিরত রাখা (ফাতহুল মাজীদ, পৃ. ৯১। )। অর্থাৎ আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করতে হবে এবং তাঁর নিষিদ্ধ সব কাজ পরিহার করতে হবে।
এই শর্তগুলো প্রখ্যাত আলেমগণ চয়ন করেছেন কুরআন ও হাদীসের আলোকেই, অতএব এ কালেমাকে শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণ করলেই যথেষ্ট এমন ধারণা ঠিক নয়।