দা’ওয়াত ও তাবলীগ কাজের নীতিমালা

দাওয়াত তাবলীগ কাজের নীতিমালা

অনুলিখন : নাজমুল চৌধুরী

কুরআনুল কারিম কি দা’ওয়াত ও তাবলীগের বিশেষ কোন নীতিমালা নির্দেশ করেছে? ‘দা’য়ী ইলাল্লাহ’ এর জন্য কি অলঙ্ঘনীয় কোন বিধান রয়েছে? দা’ওয়াত ও তাবলীগের পন্থা ও প্রকৃতি নির্ধারণ করতে হবে পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা, প্রকৃতিগত বিভিন্নতা এবং দ্বীনের কল্যাণ ও অকল্যাণের নিরিখে।

যেহেতু স্থান, কাল-পাত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে দা’ওয়াতের ধরণ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করতে হয়, আর স্থান, কাল-পাত্রের পরিবর্তন যেহেতু সৃষ্টিতে স্বাভাবিক নিয়ম, তাই একজন যথার্থ দা’ঈর জন্য উপস্থিত বুদ্ধি ও বাগ্নিতা উভয়টিই অপরিহার্য। উপরন্তু তার থাকতে হবে মানুষের সহজাত প্রকৃতি ও সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ শিরা-উপশিরার উপর গভীর জ্ঞান এবং সমাজের নাজুক ও স্পর্শকাতর দিক সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা। অতএর দা’ওয়াত প্রদানে দা’ঈ ও মুবাল্লিগের জন্য কী করণীয় এবং কী বর্জনীয়, কী তাকে বলতে হবে এবং কী সে বর্জন করবে, দা’ওয়াত প্রদানে সে কী প্রক্রিয়া অবলম্বন করবে, তার জন্য কি কোন অলঙ্ঘনীয় সুনির্দিষ্ট বিধান বা সীমারেখা আছে, এটা আগাম নির্ধারণ করে দেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ দা’ঈকে প্রতিটি পরিবর্তনশীল সমাজ ও পরিবেশ অনুসরণ করতে হয়।

দা’ওয়াত ও তাবলীগের কর্মসূচীকে কোন সংবি‌ধিবদ্ধ নীতিমালার অধীন করা হলে অবস্থা তাই দাঁড়াবে যা জনৈক ব্যক্তির তার বেতনভোগী চাকরের সাথে হয়েছিল।

ঘটনাটি নিম্নরুপঃ

জনৈক ভদ্রলোক একজন বেতনভোগী কর্মচারী নিয়োগ করলো এবং তার উপর মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ সৃষ্টি করে তাকে প্রচণ্ড রকমের ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। ফলে কর্মচারী বিরক্ত হয়ে মালিকের কাছে অনুরোধ করলো, তাকে যেন তার দায়িত্বসমূহ লিপিবদ্ধ করে দেয়। যেন সে তদনুযায়ী আপন দায়িত্ব পালন করতে পারে। মালিক তাকে কাজের সূচী তৈরী করে দিল- অমুক সময় বাজার করা, অমুক সময় ঘর ঝাড়ু দেয়া, অমুক সময় এ কাজ, অমুক সময় ঐ কাজ ইত্যাদি। কর্মচারী সূচীবদ্ধ কাজসমূহকেই তার একমাত্র দায়িত্ব মনে কাজ করে যেতে লাগল। ঘটনাক্রমে একবার বেচারা মালিক ঘোড়ায় চড়ে কোথাও যাচ্ছিল। ঘোড়ার পিঠ হতে সে নামতে গিয়ে তার দু’পা রেকাবে আটকে গেল এবং তা তার জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াল। ঘোড়া তাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চললো, এমতাবস্থায় মালিক চিৎকার করে বলছে, জলদি ছুটে আস, আমাকে বাঁচাও। কর্মচারী জবাব দিল- জনাব! একটু খানিক থামুন, সূচী দেখে নেই, আমার দায়িত্বে এ কাজটি আছে কি না। মনিবের জীবন যখন চলে যাওয়ার উপক্রম, জীবন-মৃত্যুর টানা-হেঁচড়ায় সে ব্যস্ত, এমন কঠিন মুহূর্তে চাকর মহোদয়ের ডিউটি সূচী পালন করতে গিয়ে অসহায় মালিকের জীবনটাই সাঙ্গ হয়ে গেল। নিজস্ব বেতনভোগী কর্মচারী হয়েও সে তার কোন উপকারে এল না।

দ্বীনী দা’ওয়াত ও তাবলীগের কাজটি বড়ই স্পর্শকাতর বিষয়। তার ক্ষেত্রে অনেক বিশাল ও বিস্তৃত। দা’ওয়াতের স্থান-কালের বিভিন্নতার কারণে তার নীতি ও সীমারেখাও বিভিন্ন

 

টার্গেটভিত্তিক সামষ্টিক দাওয়াতী কাজঃ

সমাজে প্রত্যেক যুগেই এমনও বহু লোক ছিলেন যাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতেন। তাঁরা ছিলেন পরহেযগার। দ্বীনের দা’ওয়াত কখনো কখনো অন্যদের সামনে তুলেও ধরতেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজে রূপান্তরিত করার জন্য যেই আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলা দরকার সেই ক্ষেত্রে তাঁদের তেমন পদচারণা আমরা দেখি না। বর্তমান অধঃপতিত মুসলিম সমাজেও যথেষ্ট সংখ্যক সৎ লোক রয়ে‌ছেন। সন্দেহ নেই, তাঁদের সুসংগঠিত আন্দোলনের উপরই নির্ভর করছে মুসলিম সমাজের সামগ্রিক সংশোধন।

ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী দর্শন ও জীবন বিধানের বিভিন্ন ধারণা গণ-মানুষের সামনে উপস্থাপন করে তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ করার নামই তাবলীগে দ্বীন। এ কাজেরই আরেক নাম দা’ওয়াত ইলাল্লাহ।

তাবলীগে দ্বীনের কার্যক্রমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যথাঃ

১) ব্যক্তিগত টার্গেট ভিত্তিক দা’ওয়াতী কাজ।

২) সামষ্টিক দা’ওয়াতী কাজ।

আসুন এই দুই ধরনের কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা কিছু আলোচনা করি।

টার্গেটভিত্তিক দাওয়াতী কাজের ফর্মূলাঃ

মুসলিম মাত্রই আল্লা-হর দ্বীনের প্রচারক। আজকের এ ব্যাপক অবনতির যুগেও এমন অনেক মুসলিম ভাইই আছেন, যারা ইসলামের দা’ওয়াত অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়াকে নিজেদের ওপর ফারয মনে করেন। কিন্তু পরিবেশ ও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে শ্রোতার মানসিক অবস্থা অনুযায়ী বক্তব্য পেশ না করায় অনেক সময় বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়।

ভালো কথা ভালো করে বলার ম‌ধ্যেই তার সার্থকতা। বিশেষ করে ইসলামের সত্য ও সুন্দর আদর্শ যারা প্রচার করেন এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব অনেক। শুধু ভালো করে বলাই নয়, শ্রোতার মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণও তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। এছাড়াও অনেক বিষয় রয়েছে যা অবশ্যই দা’ওয়াতদাতাকে মেনে চলতে হবে। যথাঃ

০১. মেধাবী, বুদ্ধিমান, কর্মঠ, চরিত্রবান, প্রভাবশালী ও নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন লোক বাছাই করে নেয়া।

০২. যেহেতু একই সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সুকঠিন সেই জন্য একজন মুবাল্লিগের কর্তব্য হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু সংখ্যক ব্যক্তিকে নির্দি‌ষ্ট করে নেয়া।

০৩. নির্বাচিত ব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করা।

০৪. সারাদিনের কোন অংশে তাঁরা কম ব্যস্ত থাকেন তা জেনে নিয়ে সেই সময় তাঁদের সাথে দেখা করতে যাওয়া।

০৫. নিজের বক্তব্য গুছিয়ে ও হৃদয়গ্রাহীরূপে পেশ করা।

০৬. তাঁরা কটুক্তি করলেও জবাবে কটুক্তি না করা।

০৭. তাঁদের সাথে নম্রভাবে আলাপ করা।

০৮. তাঁদের কাছে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে তাঁদের বিরক্তির উদ্রেক না করা।

০৯. তাঁদের প্রশ্নগুলোর সুন্দর জবাব দেয়া।

১০. যেসব প্রশ্নের জবাব জানা নেই সেগুলোর গোঁজামিল ধরণের জবাব না দিয়ে সময় চেয়ে নেয়া ও সঠিক জবাব জেনে নিয়ে পরবর্তী সাক্ষাতের সময় সে জবাব পেশ করা।

১১. মাঝে-মধ্যে তাঁদেরকে নিজের ঘরে এনে আপ্যায়ন করে আন্তরিকতা সৃষ্টি করা।

১২. তাঁদের অসুস্থতার খবর পেলে তাঁদেরকে দেখতে যাওয়া।

১৩. তাঁদেরকে মাঝে মধ্যে বই, পত্রিকা বা কোন উপহার দেয়া।

১৪. বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হ্যান্ডবিল, তাঁদের হাতে পৌঁছানো।

১৫. তাঁদের মন-মেজাজ বুঝে প্রয়োজনীয় বই পড়ানোর চেষ্টা করা।

১৬. তাঁদের কুরআন তাফসীর, হাদীস, ইসলামী বই, ইসলামী পত্র-পত্রিকা পড়ানোর চেষ্টা করা।

১৭. তাঁদেরকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করা।

১৮. সপ্তাহে অন্তত দুই দিন তাঁদের সাথে দেখা করা।

১৯. কর্মস্থলে কাজের ফাঁকে যখন সহকর্মীদের সাথে কথাবার্তা হয় তখন বেহুদা কথাবার্তা না বলে দ্বীনী কথা বলা।

২০. মাঝে মাঝে সফরে নিয়ে যাওয়া ও তাদের সাথে দ্বীনী বাক্যালাপ করার চেষ্টা করা।

 

সামষ্টিক দাওয়াতী কাজের ফর্মূলাঃ

০১. কোন মাসজিদে বা সুবিধাজনক স্থানে নিয়মিতভাবে দারসুল কুরআন অনুষ্ঠান করা।

০২. ভাল আলোচক দ্বারা কোন মাসজিদে ইসলামের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সভা অনুষ্ঠান করা।

০৩. মাসজিদ কেন্দ্রিক এলাকায় সর্বসাধারণের মাঝে, মাঝে-মাঝে অন্তত দু‌’বার গ্রুপভিত্তিক দা’ওয়াতী কাজ করা।

০৪. ইসলামী জীবন দর্শন ও জীবন বিধানের ওপর জ্ঞানগর্ভ লেখা প্রকাশ করা।

০৫. ক্যাসেটের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর বক্তৃতা গণ-মানুষের নিকট পৌঁছানো।

০৬. ঈমানের দৃঢ়তা, আক্বীদার পরিচ্ছন্নতা ও গণজাগরনের লক্ষ্যে ইসলামী বই ও পত্রিকা প্রকাশ করা।

০৭. ইসলামী পাঠাগার স্থাপন করে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্বের উপর সভা-সেমিনার করা।

০৮. বই পড়ানো ও ক্যাসেট শোনানোর জন্য গ্রাহক সৃষ্টির অভিযান চালানো।

০৯. জুমু’আর খুতবা, ঈদের খুতবার মাঝে বা অন্য কোথাও সুযোগ হলেই দ্বীনী আলোচনা পেশ করা।

১০. বিভিন্ন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বর্তমানে বিশ্বের সংবাদ পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যায়। তাই রেডিও, টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে দা’ওয়াত পৌঁছানো।

 

এভাবে এইসব কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এক প্রান্ত হতে গণ-মানুষের সামনে বার বার উপস্থাপিত হতে থাকলে ইনশা-আল্ল-হ, মানুষের চিন্তার ভ্রান্তি ক্রমশ দূর হতে থাকবে, ইসলাম সম্পর্কিত সংকীর্ণ ধারণার অবসান ঘটবে, ইসলামই যে মানুষের সত্যিকার উন্নতির গ্যারান্টি এই ধারণা বদ্ধমূল হবে এবং তাদের মনে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের আগ্রহ সৃষ্টি হবে।

দাওয়াত দেয়ার সওয়াবঃ

ঈমানদার পুরুষ ও নারী একে অপরের (দ্বীনী) সাথী ও সহযোগী। তারা যাবতীয় ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, সলাত (নামায) কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, আর আল্ল-হ ও তদীয় রসূলের আনুগত্য করে, এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলার এই ওয়াদা যে, তাদেরকে এমন জান্নাত দান করা হবে যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবহমান এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে, আর চির সবুজ শ্যামল বাগিচায় তাদের জন্য পবিত্র পরিচ্ছন্ন বসবাসের জায়গা থাকবে, আর সবচেয়ে মর্তবা এই যে, তারা আল্ল-হ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভ করবে, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সাফল্য। (সূরাহ আত্-তাওবাহ-৭১-৭২)

 

সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত; আল্ল-হর শপথ! যদি তোমার দ্বারা আল্লাহ তা’আলা একজন লোককে হিদায়াত দান করেন তাহলে তোমার জন্য একটি (বহু মূল্যের) লাল উট লাভ করার চেয়েও উত্তম হবে। (বুখারী, আবূ দাউদ হাঃ ৩৬২০)

 

“আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন; রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কাউকে সৎ পথের দিকে ডাকে, তার জন্যও সেই পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ এটা তাদের সাওয়াবের কোন অংশকেই কমাবে না; পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কাউকেও গোমরাহীর দিকে ডাকে তার জন্যও সেই পরিমাণ গুনাহ রয়েছে, যা তার অনুসারীদের জন্য রয়েছে, অথচ এটা তাদের গুনাহর একটুও কমাবে না।” (মুসলিম, মিশকাত হাঃ ১৫১)

 

“কল্যাণের পথ প্রদর্শনকারী ব্যক্তি কল্যাণকারীর ন্যায় নেকীর অধিকারী হবে।” (মুসলিম, মিশকাত হাঃ ১৯৯)

 

দাওয়াত ও তাবলীগ সম্পর্কিত অন্যান্য পোস্ট

  1. সমাজে দাওয়াতী কাজ না থাকার কুপ্রভাব
  2. বর্তমান সমাজে মুসলিমদের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা
  3. দাওয়াত ও তাবলীগ না করার ভয়াবহ পরিণতি
  4. দাওয়াত ও তাবলীগের গুরুত্ব ও তাত্পর্য

উত্স : দাওয়াত-তাবলীগের পদ্ধতি, প্রতিবন্ধকতা ও ইসলামে বন্ধুত্ব, লেখক : হাফেজ মুহাম্মাদ আইয়ূব

 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member