ভাল-মন্দ সবই কি আল্লাহর হাতে?

ভাল-মন্দ সবই কি আল্লাহর হাতে?

আল্লাহর ইচ্ছা এবং হুকুম সম্পর্কে বুঝতে হলে কিছু জিনিস লক্ষ্য রাখতে হবে।

১.

গায়েবের ওপর বিশ্বাস

এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,যারা গায়েবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়…ের উপর যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখেরাতকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে। তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম। [সুরা বাকারাহ ২-৫]

ঈমানের খুঁটিগুলোর মধ্যে আছে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, ফেরেশতাগণের ওপর বিশ্বাস, কুরআনসহ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের ওপর বিশ্বাস, সকল নবী-রাসুলগণের ওপর বিশ্বাস, আখিরাতের ওপর বিশ্বাস এবং তাকদীরের ওপর বিশ্বাস। এগুলোর সবগুলোই গায়েব। অদৃশ্য, অজানা, অদেখা। গায়েবের বিষয়গুলো আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞান কিংবা ইন্দ্রিয় দিয়ে পরিপূর্ণভাবে বোঝা অসম্ভব। যেমন ফেরেশতা। সাধারণ মানুষেরা কেউ দেখে নি কখনও। তারপরেও মুসলিম হতে হলে অবশ্যই বিশ্বাস আনতে হবে। গায়েবের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে আমাদেরকে আল্লাহতালা তাঁর কিতাবের (কুরআন) মাধ্যমে এবং তাঁর রাসুল (সা) এর মাধ্যমে (হাদিস) যতটুকু জানাবেন ততটুকু ঠিক সেভাবেই জানবো এবং বিশ্বাস করবো। এক্ষেত্রে “আমার মনে হয়”, “এমন হওয়া উচিত ছিল” ইত্যাদি খাটানো যাবে না। খাটবে না।

২.

আল্লাহ জবাবদিহি করবেন না, মানুষ করবে

তাকদীর হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছায় আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন সেটা। যেমন আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন যে কেউ চুরির অপরাধে ধরা পড়বে কিংবা মানুষ হত্যা করবে। আল্লাহ কেন এমনটিই নির্ধারণ করেছেন? এর ব্যতিক্রম কেন করলেন না? এমন প্রশ্ন করা যাবে না। যে অন্যায় করেছে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়। সে তারপরেও কেন করবে তার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

তিনি যা করেন,তৎসম্পর্কে তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন না এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে। [সুরা আল আনবিয়া ২৩]

৩.

তাকদীর কি?

তাকদীর হচ্ছে আল্লাহতাআলার মহাপরিকল্পনা। মহাবিশ্বের প্রতিটা বস্তুকে নিয়ে আল্লাহতাআলার নির্ধারিত পরিকল্পনা। তাকদীরে বিশ্বাস বলতে নিচের বিষয়গুলো বিশ্বাস করা বোঝায়।

ক. আল্লাহ সব জানেনঃ
সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথায়, কার সাথে, কী হবে, কীভাবে হবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়াদি আল্লাহতাআলা জানেন।

খ. আল্লাহ যা জানেন তা তিনি লিখে রেখেছেনঃ
আল্লাহতাআলা সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা ঘটবে সব লিখে রেখেছেন। তা লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত আছে। এর বাইরে কোন কিছুই ঘটবে না।

গ. আল্লাহর ইচ্ছাশক্তি অপ্রতিরোধ্যঃ
আল্লাহতালা যা ইচ্ছা করবেন তাই হবে। এর বাইরে কোন কিছু হওয়া সম্ভব নয়। কারও পক্ষে তাকদীর পরিবর্তন করা সম্ভব না। মহাবিশ্বে ভাল-মন্দ যা কিছু ঘটে সব তার ইচ্ছাতেই ঘটে। কালিমাতে আমরা পড়ে থাকি, “খাইরিহি ও শাররিহি মিনাল্লাহিতাআলা” – ভাল এবং মন্দ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই (আসে)।

ঘ. আল্লাহতালা আমাদের এবং আমাদের কাজগুলোর স্রষ্টাঃ
আল্লাহ বলেন, “তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা। অতএব,তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। তিনি প্রত্যেক বস্তুর কার্যনির্বাহী।“ [সুরা আনআম ১০২]

“অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমরা যা কর সবকিছুরই স্রষ্টা” [সুরা আস-সাফফাত ৯৬]

৪.

মানুষের ইচ্ছাশক্তি

আল্লাহতালা মানুষকে ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন।

বলুনঃ সত্য তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত। অতএব,যার ইচ্ছা,বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক। [সুরা কাহাফ ২৯]

আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ হয়, না হয় অকৃতজ্ঞ হয়। [সুরা ইনসান ৩]

অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে শুদ্ধ করে,সেই সফলকাম হয়। এবং যে নিজেকে কলুষিত করে,সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। [সুরা আশ-শামস ৮-১০]

বলা হয় যে, আলী (রা) কে একলোক এসে বলছিলো, আমাকে তাকদীর সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেন, এটা একটা সমুদ্রের মতন, একবার নামলে কুল খুঁজে পাবে না (অর্থাৎ মানুষের পক্ষে সাতার কেটে সমুদ্রের অপর পাড়ে পৌছানো অসম্ভব। তেমনি সীমিত জ্ঞান নিয়ে গায়েব পরিপূর্ণভাবে বোঝাও অসম্ভব)। লোকটি তারপরেও বারবার একই দাবী করতে থাকলো। আলী (রা) তখন তাকে বললেন, তোমার একটা পা তোল। লোকটি এক পা তুললো। তাকে বলা হলো, এবারে আরেক পা তোল। লোকটা বললো, এটা তো সম্ভব না। আলী (রা) বললেন, তোলার চেষ্টা কর ভালভাবে। লোকটি বললো, চেষ্টা করলেও সম্ভব না। আলী (রা) তখন বললেন যে এটাই হচ্ছে তাকদীর।

খেয়াল করার বিষয়, এইটা একটা রিয়েলিটি যে মানুষ যত চেষ্টাই করুক না কেন দুই পা একই সাথে মাটি থেকে ওপরে তোলা তার জন্য অসম্ভব। আবার একটা পাখির জন্য সম্ভব। এখন, আমরা আমাদের সীমিত ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানে যতই চেষ্টা করি না কেন যে জ্ঞানটা (গায়েব) আল্লাহতালা আমাদের কাছ থেকে আড়াল করেছেন সেটা আমরা কোনভাবেই বুঝতে পারবো না।

এবারে আসি তাকদীর ও ইচ্ছা শক্তির বিষয়ে। প্রথম পা ওঠানোর সময় (১) লোকটির ইছা শক্তি ছিল, (২) লোকটির চেষ্টা ছিল, (৩) আল্লাহর ইচ্ছা/অনুমতি ছিল। সুতরাং কাজটি করা গেছে। দ্বিতীয় পা ওঠানোর সময় (১) লোকটির ইচ্ছা ছিল, (২) লোকটির চেষ্টাও ছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা/অনুমতি ছিল না তাই করতে পারে নি। সব কাজের ক্ষেত্রেই এই তিনটি বিষয় জড়িত। এর মধে তৃতীয়টা যেটা আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে, সেটা নিয়ে কারোরই কিছু করার নেই। আল্লাহ মানুষকে শাস্তি দেবেন বা পুরষ্কৃত করবেন প্রথম দুটোর জন্য। কেউ যখন কোন খারাপ কাজ করছে তখন আল্লাহ তাকে অনুমতি দিয়েছেন খারাপ কাজ করবার, আল্লাহ না চাইলে সে তা করতে পারতো না। তবে এর সাথে তার নিজের ইচ্ছাশক্তি এবং চেষ্টা জড়িত। সেটার জন্য সে শাস্তি পাবে। ভালো কাজের জন্যও একই কথা।

মোটকথা, তাকদীর আল্লাহতা’আলা কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত। আল্লাহর ইচ্ছাশক্তি-জ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারবো না – সেটা নিয়ে মাথা ঘামানো আমাদের কাজ না, কেননা এটা গায়েব। আমাদের সামনে ভালো ও মন্দ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। এখন আমাদের ইচ্ছাশক্তি এবং চেষ্টার জন্য আমরা দায়ী থাকবো। সেটা নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে।

৫.

সতর্কতা

ইতিক্বাদ বা বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো খুব স্পর্শকাতর। এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ির কারনে অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছে অতীতে। তাকদীর বিষয়ে কেউ কেউ আল্লাহকে খারাপ কাজের দায়ভার মুক্ত করতে গিয়ে আল্লাহতাআলা কে কী করবেন সেটা জানেন না – এমন ভ্রান্ত মতে পৌছেছে। কেউ আল্লাহ জানেন তবে মানুষের কর্মকান্ডের ওপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রন নেই এমন ভ্রান্ত মত প্রচার করেছে। কেউ কেউ আবার আল্লাহকে তাকদীরের জন্য রীতিমত দোষারোপ করে কাফির হয়েছে। যেমন এদেশের বিখ্যাত কুফরী গান, “এই যে দুনিয়া কীসেরো লাগিয়া এত যত্নে গড়াইয়াছে সাঁই …” – এ সবদোষ আল্লাহতালার ওপর চাপানো হয়েছে এভাবে, “যেমনি নাচাও এমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ“ বলে।

আমাদের অবস্থান হবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা) যেভাবে বলেছেন ঠিক সেভাবে বিশ্বাস করবো। গায়েব নিয়ে অযথা প্রশ্ন করবো না।

• হাদিস – ১

আবু হুরায়রা আব্দুর রহমান ইবন সাখর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন- আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:

আমি তোমাদেরকে যেসব বিষয় নিষেধ করেছি,তা থেকে বিরত থাক। আর যেসব বিষয়ে আদেশ করেছি, যথাসম্ভব তা পালন কর। বেশী বেশী প্রশ্ন করা আর নবীদের সথে মতবিরোধ করা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ধ্বংস করে দিয়েছে।

[বুখারীঃ ৭২৮৮, মুসলিম: ১৩৩৭]

• হাদিস – ২

আবূ সা’লাবাহ্ আল-খুশানী জুরসূম ইবন নাশিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলা ফরযসমূহকে অবশ্য পালনীয় করে দিয়েছেন,সুতরাং তা অবহেলা করো না। তিনি সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,সুতরাং তা লঙ্ঘন করো না। এবং কিছু জিনিস হারাম করেছেন,সুতরাং তা অমান্য করো না। আর তিনি কিছু জিনিসের ব্যাপারে নিরবতা অবলম্বন করেছেন-তোমাদের জন্য রহমত হিসেবে; ভুলে গিয়ে নয়-সুতরাং সেসব বিষয়ে বেশী অনুসন্ধান করো না।”

[হাদীসটি হাসান (সহীহ্), আদ্-দারা কুতনী: ৪/১৮৪ ও অন্যান্য কয়েকজন বর্ণনা করেছেন।]

Collected From

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member