প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় মতিঝিল গণহত্যা

রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। গগনবিদারী ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে মাদ্রাসা ছাত্র মিজানের। জেগেই শোনে, মাইকে হেফাজত ইসলামের নেতা মাওলানা জাফরুল্লাহ খান আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘সবাই উঠুন। প্রতিরোধ করুন।’ মতিঝিলের শাপলা চত্বেরর পাশে সেনা কল্যান ভবনের সামনে বটগাছের নিচে ক্লান্ত মিজানুর রহমান ঘন্টা খানেক আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের ঘোরেই সে শুনতে পায়, চারদিকে গুলি-বোমা আর ককটেলের শব্দ। আল্লাহু আকবর শ্লোগান দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় মিজান। অন্ধকারের মাঝে সে শুধু দেখতে পায় গুলির ঝলকানি আর সাদা পোশাকের সহযোদ্ধাদের। নটরডেম কলেজ ও দৈনিক বাংলার দিক থেকে ছুটে আসছে গুলি-বোমার বিকট আওয়াজ। প্রতিরোধ শিথিল হয়ে আসে তাদের। অনেকে পিছু হটছে দেখে ১৭ বছরের তরুন মিজান পাশের বট গাছে উঠে যায়। ২টা ৪৫ মিনিটের দিকেই সরকারি বাহিনী পৌঁছে যায় শাপলা চত্বরে মূল মঞ্চে।

গাছ জড়িয়ে ধরে মনে মনে আল্লাহর জিকির করে মিজান। ঘুটঘুটে অল্পব্দকারের মাঝে বেশীদূর দেখা যাচ্ছিল না। গুলির ঝলকানির আলোতে সে দেখেছে মতিঝিল গণহত্যার দৃশ্য। পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি সদস্যরা গুলি চালিয়ে ইত্তেফাক মোড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে আসা শতাধিক গাড়িতে তোলা হয় রাস্তায় পড়ে থাকা শ’শ মানুষের লাশ। মিজান বলেন, ‘বস্তার মতো কিছু একটা দিয়ে লাশ গাড়িতে ফিক্কা দিয়ে ফেলা হয়। আনুমানিক ৩টা ১০ মিনিটের মধ্যেই পড়ে থাকা অসংখ্য লাশ গাড়িতে তোলা হয়। লাশ নিয়ে নটরডেম কলেজের দিক দিয়ে খোলা ট্রাক, মাইক্রো ও পুলিশের ভ্যানগুলো চলে যায়। আর ইত্তেফাক মোড়ের দিকে সকাল অবধি গুলি ও বিক্ষোভ-প্রতিরোধ চলে।’

মিজান ও কামরাঙ্গীর চর মাদ্রাসার তার এক সহপাঠি বটগাছ জড়িয়ে ধরেই রাত পার করে। ফজরের আজানের পর সহপাঠি নেমে চলে যায়, তবে সূর্য ওঠার পর মিজান গাছ থেকে নামে। সেনা কল্যান ভবনের গলি দিয়ে কমলাপুর হয়ে সায়েদাবাদ ও পুরোনো ঢাকা ঘুরে লালবাগের মাদরাসায় ফেরে সে। ওই মাদরাসায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মিজানের। মিজানের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় দাওরা শেষ করছে সে।

রাতের অভিযানে আনুমানিক কত জন মারা গেছে? জানতে চাইলে মিজান বলে, ‘অসংখ্য। হাজার হাজার। শ’শ গাড়িতে লাশ উঠানো হয়।’ সরকারি বাহিনীর অভিযান কতক্ষণ চলে প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, ‘রোববার সকাল থেকেই তো হামলা-অভিযান শুরু হয়। গুলি-টিয়ারশেল-বোমার মাঝেই আমরা মতিঝিলে ছিলাম। রাত ২টার পর হাজার হাজার ব্রাশ ফায়ার করা হয়। অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। রাত ১টার পর জিকির করতে করতে অনেকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমাদের হাতে লাঠিও ছিল না।’ অভিযান শেষ হয় কখন প্রশ্নের জবাবে মিজান বলে, ‘সকালেও অভিযান চলতে থাকে। অলিগলিতে লড়াই হয়। বিভিন্ন ভবনের ভেতর থেকে আমাদের লোকজন ধরে নিয়ে আসে পুলিশ। তাদেরকে লাঠিপেটা করে। ইত্তেফাক মোড়ের দিকে সকাল ৭টার দিকেও গুলির শব্দ শুনেছি।’

একই মাদ্রাসার ছাত্র মইনুদ্দীনের বর্ণনা আরো ভয়ংকর। সময়ের উল্লেখ করতে না পারলেও গণহত্যার চিত্র তুলে ধরে সে এ প্রতিবেদককে বলে, ‘অসংখ্য ভাই শহীদ হয়েছে। আমি শাপলা চত্বরের পাশেই গলির ভেতরে ঢুকে পড়ি। সেখানে বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিই। গলির মুখে দাড়িয়ে কয়েক ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিরোধে অংশ নেই। তখন দেখি, শাপলা চত্বরের চারিদিকে কেবল লাশ আর লাশ। পুলিশের গাড়ির আলোয় পিচঢালা রাস্তায় রক্ত গড়িয়ে যেতে দেখেছি। টেনে টেনে লাশ গাড়িতে তোলা হচ্ছে দেখে আমি বন্ধুর বাসায় ঢুকে পড়ি।’

গণহত্যার দৃশ্য দেখার জঘণ্য অভিজ্ঞতা বর্ণনায় মিজানুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মৃত্যুকে আর পরোয়া করি না। অসংখ্য ভাইয়ের শাহাদতের দৃশ্য দেখিয়ে আল্লাহ ঈমানকে আরো শক্তিশালী করেছে। কিন্তু, আমি শাহাদতবরণ করতে পারিনি। ইসলামের পথে লড়াই করে আল্লাহ যেন শহীদ করে।’ এসব বলেই কেঁদে ফেলে মিজান। বলে, ‘দোয়া করবেন, আল্লামা শফি হুজুরের নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এ লড়াই যেন সফল হয়। রক্ত ও শাহাদত যেন বিফলে যায় না।’

প্রসঙ্গত, নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি এবং আল্লাহ ও রাসূল সা.-কে অবমাননায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাশ করাসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে রোববার ঢাকা অবরোধ করে দেশের ওলামা-মাশায়েখদের প্লাটফর্ম হেফাজতে ইসলাম। রাজধানীর ৬টি প্রবেশ দ্বারে অবরোধের পাশাপাশি তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ করে। শাপলা চত্বর ঘিরে হেফাজতে ইসলামের জমায়েত দৈনিক বাংলা হয়ে পল্টন মোড়, বিজয়নগর, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, নটরডেম কলেজ হয়ে ইত্তেফাক মোড় জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে করে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে মতিঝিল ছাড়তে হেফাজতে ইসলামকে সময় বেধে দেন। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেন তিনি।

দাবি না মানায় লাখ লাখ মানুষের এ সমাবেশকে অবস্থানে পরিণত করা হয়। রোববার রাত ৯টার দিকে আল্লামা শাহ আহমদ শফী দাবি না মানা পর্যন্ত সবাইকে রাজপথে অবস্থান করার নির্দেশ দেন। রোববার দিনভর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নির্বিচারে গুলিতে মতিঝিলের সমাবেশে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়। আহত হয় সহস্রাধিক। রাত বাড়তে থাকলে সরকারি বাহিনীর হামলার নিষ্ঠুরতা বাড়তে থাকে। আর রাত ২টার পর ১০ হাজার পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি’র যৌথ বাহিনীর অভিযান চালানো হয়।

– NewsEvent24.com

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button