দরসে কুরআন : দ্বীনের উপর দৃঢ়তা

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ- نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ- نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ- –

অনুবাদ : ‘নিশ্চয় যারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। অতঃপর তাতে অবিচল থাকে। তাদের উপর ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না ও চিন্তান্বিত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর’। ‘ইহকালীন জীবনে ও পরকালে আমরা তোমাদের বন্ধু। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা দাবী করবে’। ‘সেটি হবে আপ্যায়ন ক্ষমাশীল ও দয়াবানের পক্ষ হ’তে’ (ফুছ্ছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০-৩২)

ইস্তিক্বামাত (الاسةقامة) অর্থ দৃঢ়তা, স্থিরতা। এখানে অর্থ আল্লাহর দ্বীনের উপর এখলাছের সাথে দৃঢ় থাকা। তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। সুখে-দুখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর খুশী থাকা ও তাঁর উপর ভরসা করা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।

দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার জন্য আল্লাহ ও তাঁর বিধানসমূহের উপর ইস্তেক্বামাত বা দৃঢ়চিত্ততা সর্বাপেক্ষা যরূরী। এটা হবে বিশ্বাসে, কথায় ও কর্মে। বিশ্বাসে দৃঢ়তা না থাকলে কথায় ও কর্মে দৃঢ়তা থাকে না। সুফিয়ান বিন আব্দুল্লাহ ছাক্বাফী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন কথা বলে দিন যে, আপনার পরে আমাকে আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে না হয়। জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, قُلْ آمَنْتُ بِاللهِ ثُمَّ اسْتَقِمْ  ‘তুমি বল আমি আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতঃপর এর উপর দৃঢ় থাক’।[1] অর্থাৎ তুমি স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা কর। অন্যকে শরীক করো না। আর আল্লাহর বিধান সমূহ মেনে চলার ব্যাপারে দৃঢ় থাক। দুনিয়াবী স্বার্থের সাথে আপোষ করো না। আল্লাহ বলেন,

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ- ‘তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিচার-ফায়ছালা কামনা করে? অথচ দৃঢ় বিশ্বাসীদের নিকট আল্লাহর চাইতে উত্তম ফায়ছালাকারী আর কে আছে?’ (মায়েদাহ ৫/৫০)

এতে বুঝা গেল যে, বিশ্বাসের মধ্যে এখলাছ না থাকলে কথা ও কর্ম কোনটাই আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। বান্দার কাছেও প্রথমদিকে চটকদার মনে হ’লেও অবশেষে তা কবুল হবে না। ফলে ঐ ব্যক্তি ইহাকালে ও পরকালে ব্যর্থ হবে।

চার প্রকারের মানুষ :

সমাজে চার ধরনের মানুষ রয়েছে। দৃঢ় বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী ও শিথিল বিশ্বাসী। অবিশ্বাসীরা দিশাহীন পথিক। ওরা পথভ্রষ্ট। ওদের আচরণ পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট। কপট বিশ্বাসীরা সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানী। এরা বলে এটাও ঠিক, ওটাও ঠিক। এরা মানুষের ঘৃণার পাত্র। এরা জাহান্নামের সর্বনিম্নস্তরে থাকবে। শিথিল বিশ্বাসীরা ভীরু ও কাপুরুষ। এরা সর্বদা অন্যের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। সমাজে এদের সংখ্যাই বেশী।

প্রথমোক্ত লোকেরাই সমাজের নেতা ও পরিচালক। তারা যদি প্রবৃত্তি পূজারী হয় ও তার উপর দৃঢ় থাকে, তাহ’লে তারা হয় হঠকারী ও সমাজ ধ্বংসকারী। পক্ষান্তরে তারা যদি আল্লাহভীরু হয় এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধের উপর দৃঢ় থাকে, তাহ’লে তারা হয় সমাজের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। অনেক সময় অনেক দ্বীনদার মানুষকে চরমপন্থী হ’তে দেখা যায়। এটা হয়ে থাকে তাদের দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে। এদের থেকে বেঁচে থাকার জন্য রাসূল (ছাঃ) উম্মতকে সাবধান করে গেছেন’।[2] শৈথিল্যবাদীদের অবস্থা আরও করুন। উভয় দল হ’তে দূরে থেকে সর্বদা মধ্যপন্থী আহলুল হাদীছ হ’তে হবে।

আল্লাহ তাঁর পথকে ‘মুস্তাক্বীম’ বলেছেন। যার অর্থ সরল ও সুদৃঢ়। তিনি বলেন, وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ- ‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ সমূহ থেকে) বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)

আল্লাহর পথ সুদৃঢ়। যা ভঙ্গুর নয়, পরিবর্তনশীল নয়, বরং সদা মযবুত এবং অপরিবর্তনীয়। যা কারু অনুগামী হবে না। বরং সবাই তার অনুসারী হবে। যা যুগের হাওয়ায় পরিবর্তন হয় না। বরং যুগকে সে পরিবর্তন করে। অতএব ছিরাতে মুস্তাক্বীমের অনুসারীদের জন্য দ্বীনের উপর ইস্তিক্বামাত বা দৃঢ়তা অপরিহার্য। নইলে তার উক্ত দাবী মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে।

বস্ত্ততঃ দ্বীনের উপর দৃঢ়তাই হ’ল মূল বস্তু।  এটা ব্যতীত কোন কিছুই অর্জিত হয় না। এজন্য আল্লাহ তার নবীকে নির্দেশ দেন, فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلاَ تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ- ‘অতএব তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছ সেভাবে দৃঢ় থাক এবং যারা তোমার সাথে (শিরক ও কুফরী থেকে) তওবা করেছে তারাও। আর তোমরা সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের সকল কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেন’ (হূদ ১১/১১২)

আবু বকর (রাঃ) একবার রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। জওয়াবে তিনি বললেন, شَيَّبَتْنِى هُودٌ وَالْوَاقِعَةُ وَالْمُرْسَلاَتُ وَ عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ وَ إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ- ‘আমাকে বৃদ্ধ করেছে সূরা হূদ, ওয়াক্বি‘আহ, মুরসালাত, নাবা, তাকভীর প্রভৃতি সূরাগুলি।[3] অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকতে গিয়ে এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ সমূহ যথাযথভাবে পালন করতে গিয়ে শয়তানের মোকাবিলায় দৃঢ়চেতা মুমিনকে প্রতি পদে পদে জিহাদ করতে হয়।

এভাবেই সে আল্লাহর পথে মুজাহিদ হিসাবে শহীদী মৃত্যু বরণ করে। যেভাবে আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেন, সেভাবেই সে খুশী থাকে। যদিও সে মৃত্যু তার ঘরের বিছানায় হয় (وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ) । রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন,مَنْ قُتِلَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ وَمَنْ مَاتَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হ’ল সে ব্যক্তি শহীদ এবং যে আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করল সে ব্যক্তি শহীদ’।[4]

দুনিয়াবী লাভ :

ইস্তেক্বামাতের দুনিয়াবী লাভ হ’ল ফেরেশতারা তার বন্ধু হবে। যারা আল্লাহর হুকুমে সর্বাবস্থায় তাকে সাহায্য করবে। আর ফেরেশতা যার সাহায্যকারী হবে, দুনিয়া তার গোলাম হবে। বিভিন্ন বিপদাপদে মুমিন-মুত্তাক্বীগণ অলৌকিকভাবে আল্লাহর গায়েবী মদদ পেয়ে থাকেন। যা ইতিপূর্বে তাদের কল্পনায়ও ছিল না। আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন’ (তালাক্ব ৬৯/৩)। তিনি বলেন,

كَذَلِكَ حَقًّا عَلَيْنَا نُنْجِ الْمُؤْمِنِينَ ‘আর এভাবেই আমাদের কর্তব্য হল ঈমানদারগণকে নাজাত দেওয়া’ (ইউনুস ১০/১০৩)

অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে ও সেই সাথে ঈমানদার নর-নারীকে নিশ্চিত সান্ত্বনাবাণী শুনিয়েছেন যে, সকল যুগে এটাই আল্লাহর রীতি ও কর্তব্য যে, তিনি ঈমানদারগণকে নাজাত দেন ও কাফের-বেঈমানদের ধ্বংস করেন। সাময়িকভাবে মিথ্যা জয়ী হলেও সত্য চিরকাল বিজয়ী।

পরকালীন লাভ :

দুনিয়াবী জীবন শেষে আখেরাতের পথে যাত্রার পূর্বক্ষণে  মৃত্যুকালে ফেরেশতারা এসে বলবে, لاَ تَخَافُوا ‘ভয় পেয়োনা’। ইতিপূর্বে তুমি আল্লাহর জন্য এখলাছের সাথে নেক আমল করেছ। এখন তুমি তার প্রতিদান পাবে। তারা বলবে وَلاَ تَحْزَنُوا ‘চিন্তান্বিত হয়ো না’। দুনিয়ায় যে সন্তান-সন্ততি রেখে যাচ্ছ, আল্লাহর হুকুমে আমরাই তাদের পৃষ্ঠপোষক হব। তাছাড়া যেসব গোনাহ তোমার রয়েছে, সব আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন। অতঃপর وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ তুমি জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর। যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের আগেই দেওয়া হয়েছে’।

কুরআনের উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা নিম্নোক্ত হাদীছ দু’টিতে পাওয়া যায়। (ক) আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

 مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللهِ أَحَبَّ اللهُ لِقَاءَهُ وَمَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللهِ كَرِهَ اللَّهُ لِقَاءَهُ. قُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ كُلُّنَا نَكْرَهُ الْمَوْتَ. قَالَ لَيْسَ ذَاكَ كَرَاهِيَةَ الْمَوْتِ وَلَكِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا حُضِرَ جَاءَهُ الْبَشِيرُ مِنَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ بِمَا هُوَ صَائِرٌ إِلَيْهِ فَلَيْسَ شَىْءٌ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَكُونَ قَدْ لَقِىَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ فَأَحَبَّ اللهُ لِقَاءَهُ وَإِنَّ الْفَاجِرَ أَوِ الْكَافِرَ إِذَا حُضِرَ جَاءَهُ بِمَا هُوَ صَائِرٌ إِلَيْهِ مِنَ الشَّرِّ أَوْ مَا يَلْقَاهُ مِنَ الشَّرِّ فَكَرِهَ لِقَاءَ اللهِ وَكَرِهَ اللهُ لِقَاءَهُ-

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতকে ভালবাসে, আল্লাহ তার সাক্ষাতকে ভালবাসেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ অপসন্দ করে, আল্লাহ তার সাক্ষাতকে অপসন্দ করেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা সবাই মৃত্যুকে অপসন্দ করি। তিনি বললেন, মৃত্যুকে অপসন্দের বিষয়টি নয়। বরং মুমিনের কাছে যখন মৃত্যু এসে যায়, তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সুসংবাদদাতা ফেরেশতা তার নিকটে আগমন করে, ঐ বস্তু নিয়ে যা তার নিকটে পৌঁছানোর যোগ্য। তখন তার নিকটে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের চাইতে প্রিয়তর বস্ত্ত আর কিছুই থাকেনা। অতঃপর আল্লাহ তার সাক্ষাতকে ভালবাসেন। পক্ষান্তরে পাপাচারী অথবা অবিশ্বাসী ব্যক্তির যখন মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন ফেরেশতা তার নিকটে মন্দ কিছু নিয়ে আগমন করেন। তখন সে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতকে অপসন্দ করে। ফলে আল্লাহও তার সাক্ষাৎ অপসন্দ করেন’।[5]

(খ) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,

الْمَيِّتُ تَحْضُرُهُ الْمَلاَئِكَةُ فَإِذَا كَانَ الرَّجُلُ صَالِحًا قَالُوا : اخْرُجِى أَيَّتُهَا النَّفْسُ الطَّيِّبَةُ كَانَتْ فِى الْجَسَدِ الطَّيِّبِ اخْرُجِى حَمِيدَةً وَأَبْشِرِى بِرَوْحٍ وَرَيْحَانٍ وَرَبٍّ غَيْرِ غَضْبَانَ فَلاَ يَزَالُ يُقَالُ لَهَا ذَلِكَ حَتَّى تَخْرُجَ ثُمَّ يُعْرَجُ بِهَا إِلَى السَّمَاءِ فَيُفْتَحُ لَهَا فَيُقَالُ مَنْ هَذَا فَيَقُولُونَ فُلاَنٌ. فَيُقَالُ مَرْحَبًا بِالنَّفْسِ الطَّيِّبَةِ كَانَتْ فِى الْجَسَدِ الطَّيِّبِ ادْخُلِى حَمِيدَةً وَأَبْشِرِى بِرَوْحٍ وَرَيْحَانٍ وَرَبٍّ غَيْرِ غَضْبَانَ. فَلاَ يَزَالُ يُقَالُ لَهَا ذَلِكَ حَتَّى يُنْتَهَى بِهَا إِلَى السَّمَاءِ الَّتِى فِيهَا اللهُ عَزَّ وَجَلَّ-

‘মৃত্যু পথযাত্রী সৎকর্মশীল মুমিনের নিকট ফেরেশতারা হাযির হয়ে বলেন, বেরিয়ে এস হে পবিত্র আত্মা! যা পবিত্র দেহে ছিল। বেরিয়ে এস প্রশংসিতভাবে। সুসংবাদ গ্রহণ কর শান্তি ও সুগন্ধির এবং সেই প্রতিপালকের যিনি ক্রুদ্ধ নন। এভাবেই তারা বলতে থাকবেন। অবশেষে রূহ বেরিয়ে আসবে। অতঃপর তাকে নিয়ে তারা আসমানে চলে যাবেন। তখন তার জন্য দরজা খোলার অনুমতি চাওয়া হবে। বলা হবে, কে এই ব্যক্তি? ফেরেশতারা বলবেন, অমুক। বলা হবে পবিত্র আত্মার প্রতি মারহাবা। যা পবিত্র দেহে ছিল। প্রবেশ করুন! প্রশংসিতভাবে। সুসংবাদ গ্রহণ করুন! শান্তি ও সুগন্ধির এবং ঐ প্রতিপালকের যিনি ক্রুদ্ধ নন। এভাবেই তাকে বলা হবে। অবশেষে তারা সেই সর্বোচ্চ স্থানে উপস্থিত হবেন, যেখানে মহান আল্লাহ রয়েছেন’…।[6]

যায়েদ বিন আসলাম বলেন, এইভাবে ফেরেশতাগণ তাকে সুসংবাদ দিবেন তার মৃত্যুর সময়, তার কবরে এবং তাকে পুনরুত্থানের সময়’। এমনকি তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেওয়া ও সেখানে গিয়ে তার সেবা-যত্ন করা সবই ফেরেশতারা করবেন।

কয়েকজন দৃঢ়চিত্ত মুমিনের দৃষ্টান্ত

(১) খুবাইব বিন ‘আদী : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে প্রেরিত ১০ জন মুবাল্লিগ দলের তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। দাওয়াতকারীরা বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে তাদের সবাইকে হত্যা করে। খোবায়েব ও যায়েদ বিন দাছেনাকে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা না করে মক্কায় কাফেরদের নিকট বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখানে তাদেরকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়। শূলে চড়ার আগে খোবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, ‘আমি ভীত হয়েছি’ এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর তিনি কাফেরদের প্রতি বদ দো‘আ করেন এবং মর্মন্তুদ কবিতা পাঠ করেন। তাঁর পঠিত দশ লাইন কবিতার বিশেষ দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ-

وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا + عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ فِي اللهِ مَصْرَعِي

وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ  يَشَأْ + يُبَارِكْ  عَلَى  أَوْصَالِ  شِلْوٍ  مُمَزَّعِ

‘আর আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোন পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে শোয়ানো হচ্ছে’। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।[7]

মৃত্যুর পূর্বে খোবায়েবের শেষ বাক্য ছিল- اللَّهمَّ إنَّا قَدْ بَلَّغْنَا رِسَالَةَ رَسُولِكَ، فَبَلِّغْهُ الْغَدَاةَ مَا يُصْنَعُ بِنَا- ‘হে আল্লাহ, আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে তুমি তাঁকে আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি কাল সকালে পৌঁছে দাও’।

ওমর (রাঃ)-এর গভর্ণর সাঈদ বিন আমের (রাঃ) যিনি খোবায়েবের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের নিহত হবার দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কতবড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে থোকা থোকা আঙ্গুর খেতে দেখা গেছে। অথচ ঐসময় মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না’।

(২) যায়েদ বিন দাছেনাহ : তাকে হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবার সহ বেঁচে থাক? তিনি বলেন, وَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنَّ مُحَمَّدًا الْآنَ فِي مَكَانِهِ الَّذِي هُوَ فِيهِ تُصِيبُهُ شَوْكَةٌ تُؤْذِيْهِ- ‘আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে মুহাম্মাদ আসুক এবং তাকে একটি কাঁটারও আঘাত লাগুক’। হারাম এলাকা থেকে বের করে ৬ কিঃ মিঃ উত্তরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে তাঁকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়।[8]

(৩) খাব্বাব ইবনুল আরাত : বনু খোযা‘আ গোত্রের জনৈকা মহিলা উম্মে আনমার-এর গোলাম ছিলেন। তিনি কর্মকারের কাজ করতেন। প্রথম দিকের ইসলাম প্রকাশকারী এবং ষষ্ঠ মুসলমান ছিলেন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে মুশরিক নেতারা তার উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। নানাবিধ অত্যাচারের মধ্যে সবচাইতে মর্মান্তিক ছিল এই যে, তাকে জ্বলন্ত লোহার উপরে চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল। ফলে পিঠের চামড়া ও মাংস গলে অঙ্গার নিভে গিয়েছিল। নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গমন করেন। তখন তিনি কা‘বা চত্বরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করার জন্য আকুলভাবে দাবী করেন। তখন উঠে রাগতঃস্বরে রাসূল (ছাঃ) তাকে দ্বীনের জন্য বিগত উম্মতগণের কঠিন নির্যাতন ভোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বলেন,

كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِى الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلاَّ اللهَ أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ-

‘তোমাদের পূর্বের জাতিসমূহের লোকদের মাথার মাঝখানে করাত রেখে দেহকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু তা তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তাদের দেহ থেকে লোহার চিরুনী দিয়ে গোশত ও শিরাসমূহ হাড্ডি থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে। তথাপি এগুলি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মনে রেখ, ‘আল্লাহর কসম! অবশ্যই তিনি এই ইসলামী শাসনকে এমনভাবে পূর্ণতা দান করবেন যে, একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ থেকে হাযারা মাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে, অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করবে না। অথবা তার ছাগপালের উপরে নেকড়ের ভয় করবে। কিন্তু তোমরা বড়ই ব্যস্ততা দেখাচ্ছ’।[9] এ হাদীছ শোনার পরে তার ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়।

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একদিন খাববাবকে ডেকে বলেন, তোমার উপরে নির্যাতনের কাহিনী আমাকে একটু শুনাও। তখন তিনি নিজের পিঠ দেখিয়ে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পিঠ দেখুন। আমাকে জ্বলন্ত লোহার আগুনের উপরে চাপা দিয়ে রাখা হ’ত। আমার পিঠের মাংস গলে উক্ত আগুন নিভে যেত’। তখন ওমর (রাঃ) বলেন, এরূপ দৃশ্য আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি’। তিনি ছিফফীন ও নাহরাওয়ানের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে ছিলেন। ছিফফীন যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরে আলী (রাঃ) তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বদর-ওহোদসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন’।

পরবর্তীতে খাব্বাব ইবনুল আরাত (রাঃ)-এর কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলী (রাঃ) তার জন্য দো‘আ করে বলেন,رَحِمَ اللهُ خَبَّابًا، لَقَدْ أَسْلَمَ رَاغِبًا، وَهَاجَرَ طَائِعًا، وَعَاشَ مُجَاهِدًا، وَابْتُلِيَ فِي جِسْمِهِ أَحْوَالاً، وَلَنْ يُضَيِّعَ اللهُ أَجْرَهُ- ‘আল্লাহ রহম করুন খাববাবের উপর, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আগ্রহের সাথে, হিজরত করেছিলেন আনুগত্যের সাথে, জীবন যাপন করেছেন মুজাহিদ হিসাবে, নির্যাতিত হয়েছেন দৈহিক ভাবে বিভিন্ন অবস্থায়। অতএব কখনোই আল্লাহ তার পুরস্কার বিনষ্ট করবেন না’।

উমার ও ‌উসমান (রাঃ)-এর আমলে যখন মুসলমানদের সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তখন অগ্রবর্তী মুহাজির হিসাবে খাব্বাব (রাঃ)-এর জন্য বড় অংকের রাষ্ট্রীয় ভাতা নির্ধারণ করা হয়। যাতে তিনি বহু সম্পদের অধিকারী হন এবং কূফাতে বাড়ি করেন। এসময় তিনি একটি কক্ষে অর্থ জমা রাখতেন। যা তার সাথীদের জানিয়ে দিতেন। অতঃপর অভাবগ্রস্তরা সেখানে যেত এবং প্রয়োজনমত নিয়ে নিত। তিনি বলতেন,

وَلَقَدْ رَأَيْتُنِي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا أَمْلِكُ دِينَارًا وَلا دِرْهَمًا وَإِنَّ فِي نَاحِيَةِ بَيْتِي فِي تَابُوتِي لأَرْبَعِينَ أَلْفٍ وَافٍ. وَلَقَدْ خَشِيتُ أَنْ تَكُونَ قَدْ عُجِّلَتْ لَنَا طَيِّبَاتُنَا فِي حَيَاتِنَا الدُّنْيَا-

‘আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তখন আমি একটি দীনার বা দিরহামেরও মালিক ছিলাম না। আর এখন আমার সিন্দুকের কোণায় চল্লিশ দীনার জমা আছে। আমি ভয় পাচ্ছি আল্লাহ আমার সকল নেক আমলের ছওয়াব আমার জীবদ্দশায় আমার ঘরেই দিয়ে দেন কি-না!’।

মৃত্যুর সময় তাকে পরিচর্যাকারী জনৈক সাথী বললেন, أَبْشِرْ يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، فَإِنَّكَ مُلاَقٍ إِخْوَانَكَ غَدًا- ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কেননা কালই আপনি আপনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হবেন’।

জবাবে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ذَكَّرتموني أقواماً، وإخواناً مَضَوْا بِأُجُورهم كُلِّهَا لَمْ يَنالُوا مِن الدُّنيا شَيْئًا- ‘তোমরা আমাকে এমন ভাইদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে, যারা তাদের সম্পূর্ণ নেকী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। দুনিয়ার কিছুই তারা পাননি’। আর আমরা তাঁদের পরে বেঁচে আছি। অবশেষে দুনিয়ার অনেক কিছু পেয়েছি। অথচ তাঁদের জন্য আমরা মাটি ব্যতীত কিছুই পাইনি। এসময় তিনি তার বাড়ি এবং বাড়ির সম্পদ রাখার কক্ষের দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, মদীনায় প্রথম দাঈ ও ওহোদ যুদ্ধের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন উমায়ের শহীদ হওয়ার পর কিছুই ছেড়ে যায়নি একটি চাদর ব্যতীত। অতঃপর তিনি তার কাফনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হামযার জন্য এতটুকু কাফনও জুটেনি। মাথা ঢাকলে পা ঢাকেনি। পা ঢাকলে মাথা ঢাকেনি। অতঃপর সেখানে ইযখির ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়েছিল’। তিনি ৩৭ হিজরীতে ৬৩ বছর বয়সে কূফায় ইন্তেকাল করেন।[10]

এখানে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, নির্যাতিত এই মানুষটিকে কঠিনভাবে ধমক দেওয়ার পরেও তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে দলত্যাগ করেননি। বরং তার ঈমান আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সম্পদ লাভে তিনি খুশী হননি। বরং বিগতদের তুলনায় নিজেকে হীন মনে করেছেন।

জান্নাতে আল্লাহর সম্ভাষণ :

أُولَئِكَ يُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوا وَيُلَقَّوْنَ فِيهَا تَحِيَّةً وَسَلَامًا- خَالِدِينَ فِيهَا حَسُنَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا-

‘ঐ সকল ব্যক্তিকে তাদের ছবরের বিনিময়ে জান্নাতে কক্ষ দেওয়া হবে এবং তাদেরকে সেখানে সম্ভাষণ ও সালাম জানানো হবে’। ‘সেখানে তারা চিরকাল বসবাস করবে। অবস্থানস্থল ও বাসস্থান হিসাবে সেটি কতই না উত্তম’ (ফুরক্বান ২৫/৭৫-৭৬)

আল্লাহ জান্নাতীদের উদ্দেশ্যে সেদিন বলবেন, يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ- ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً- فَادْخُلِي فِي عِبَادِي- وَادْخُلِي جَنَّتِي- ‘হে প্রশান্ত আত্মা!’। ‘ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে, সন্তুষ্ট চিত্তে ও সন্তোষভাজন অবস্থায়’। ‘অতঃপর প্রবেশ কর আমার বান্দাদের মধ্যে’। ‘এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে’ (ফজর ৮৯/২৭-৩০)

এখানে মুমিনদের হৃদয়কে ‘নাফসে মুত্বমাইন্নাহ’ বা প্রশান্ত আত্মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ অবিশ্বাসীরা যতই দুনিয়াবী ভোগ-বিলাস ও বিত্ত-বৈভবের মধ্যে জীবন যাপন করুক না কেন, তারা হৃদয়ের প্রশান্তি হ’তে বঞ্চিত থাকে। পক্ষান্তরে প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি সুখে-দুখে সর্বদা আল্লাহর উপরে ভরসা করেন এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকেন। এই সকল ঈমানদারগণের আলোকিত হৃদয়কে উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ এখানে ‘প্রশান্ত আত্মা’ বলে সম্বোধন করেছেন। যা ঈমানদার নর-নারীর জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে এক অতীব স্নেহময় আহবান। এর চাইতে মূল্যবান উপঢৌকন মুমিনের জন্য আর কি হ’তে পারে?

বস্তুতঃ দুনিয়াপ্রেমের শয়তানী ধোঁকার অন্ধকার কেটে গিয়ে আল্লাহপ্রেমের জ্যোতি যখন হৃদয়ে বিচ্ছুরিত হয়, তখন ঈমানের দ্যুতিতে মুমিন এতই শক্তি লাভ করে যে, জীবনকে সে তুচ্ছ মনে করে। প্রেমাস্পদ আল্লাহর সাথে মিলনের জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ফেরাঊনের কঠোরতম শাস্তিকে তাই তুচ্ছ জ্ঞান করে তার সতীসাধ্বী স্ত্রী আসিয়া মৃত্যুর আগে আকুল কণ্ঠে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন,

رَبِّ ابْنِ لِيْ عِندَكَ بَيْتاً فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِيْ مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِيْ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ-

‘হে আমার পালনকর্তা! আমার জন্য তোমার নিকটে জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ কর এবং আমাকে ফেরাঊন ও তার দুষ্কর্ম হ’তে এবং এই যালেম কওমের হাত থেকে মুক্তি দান কর’ (তাহরীম ৬৬/১১)

ইস্তিক্বামাত হাছিলের উপায় সমূহ :

(১) প্রতি ছালাতে আল্লাহর নিকটে ছিরাতে মুস্তাক্বীম প্রার্থনা করা। যেটি সূরা ফাতিহাতে করা হয়ে থাকে।

(২) আল্লাহর নিকটে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের তৌফিক কামনা করা। কেননা আল্লাহর  রহমত ব্যতীত এটি পাওয়া সম্ভব নয়।

(৩) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ব্যতীত অন্যদিকে মুখ না ফিরানো। কেননা শিরক ও বিদ‘আতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাছিল করা যায় না।

(৪) দ্বীনের সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। এজন্য আল্লাহভীরু তাওহীদপন্থী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হ’তে হবে।

(৫) নেককার সাথী ও সংগঠন তালাশ করা ও তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকা (তাওবা ৯/১১৯; ইউসুফ ১২/১০৮; যুখরুফ ৪৩/৬৭)

(৬) আল্লাহ বিরোধী সকল চিন্তা ও কর্ম থেকে বিরত থাকা। এজন্য বাতিলপন্থী সাহিত্য ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া পরিহার করতে হবে।

(৭) সর্বদা আল্লাহর নিকট তওবা, ক্ষমা প্রার্থনা ও আত্মসমালোচনা করা।

এগুলি মুমিনকে দ্বীনের উপরে দৃঢ় থাকতে সহায়তা করবে এবং পথভ্রষ্টতা থেকে দূরে রাখবে ইনশাআল্লাহ

ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব


[1]. আহমাদ হা/১৫৪৫৪; মুসলিম হা/৩৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[2]. বুখারী হা/৩৩৪৪।

[3]. তিরমিযী হা/৩২৯৭, সনদ জাইয়িদ; হাকেম হা/৩৩১৪, হাদীছ ছহীহ।

[4]. মুসলিম হা/১৯০৯; মিশকাত হা/৩৮১১।

[5]. আহমাদ হা/১২০৬৬, সনদ ছহীহ।

[6]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৬২; মিশকাত হা/১৬২৭, ‘জানায়েয’ অধ্যায়।

[7]. বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯; ইবনু হিশাম ২/১৭৬।

[8]. বিস্তারিত দ্রঃ সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), ৩৫৮-৫৯ পৃঃ।

[9]. বুখারী হা/৩৬১২, ৬৯৪৩; মিশকাত হা/৫৮৫৮।

[10]. বিস্তারিত দ্রঃ সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), ১৩৩-৩৪ পৃঃ।

 

সৌজন্যেঃ iOnlinemedia

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot gacor skybet88 slot online skybet88 skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 skybet88 slot shopeepay slot gacor skybet88 demo slot skybet88 skybet88 skybet88 skybet88