সবর বা ধৈর্য

১. 

খেতে বসেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সিদ্দিকা। রোজই হয় কাঠালের বিঁচি দিয়ে শুটকির ঝোল আর না হয় কলতলার বেড়ায় লতিয়ে উঠা পুই শাক ভাজা। শেষ কবে মাছ খেয়েছিলো?

নাহ! একদমই মনে নেই তার। মা বললেন, তিনবেলা ভাত খেতে পাচ্ছিস আল্লাহর শোকর কর। কতো মানুষ না খেয়েই থাকে দিনের পর দিন। সিদ্দিকা চোখের পানি মুছে আর মনে মনে বলে “মালিক আমি জানি আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমায়, ধৈর্য দিন আমাদের।”

এইতো সেদিনের ঘটনা – সেদিন দুপুরে ডাল ছাড়া আর কিছুই নেই। সিদ্দিকা ডাল খেতে পারেনা। ওর কান্না কান্না লাগে। কিন্তু বাঁচতে গেলেতো খেতেই হবে। মাত্র খেতে বসেছে অমনি কই থেকে এক মহিলা এলো, হুম ওদের বাসায় কাজ করতো আগে এই মহিলা। সে আজ সিদ্দিকাদের জন্য মাছ নিয়ে এসেছে। ওর ভেতরের কান্না সে আর চেপে রাখতে পারলোনা! চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আর কতো মালিক? আর কতো? মায়ের চোখও তখন সজল। ভাবতেই পারেননি যারা একসময় তাদের বাসায় কাজ করতো ঠিক তারাই আজ মাছ নিয়ে এসেছে।

২.

ফাতিমা বেগমের পাঁচ সন্তান আর স্বামী থাকেন এশিয়ার সবচেয়ে ধনী একটি দেশে। তার গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, আবাদী জমি। শ্বশুরের থেকে পাওয়া বাড়ি বাদেও আরো দুটো বাড়ি কিনেছেন তার স্বামী। আছে নিজেদের বিউটি পার্লার, আরো আছে ঢাকায় দোকান। ব্যাংকও জমানো আছে লাখ দশেক টাকা। অভাব শব্দটার সাথে অপরিচিত তিনি।

কথায় আছে আল্লাহ্ নাকি মন বুঝেই ধন দেন। ফাতিমাকেও তাই দিয়েছেন। ফাতিমার দুয়ার থেকে কখনো কোনো ভিখেরী খালি হাতে যায় না। কাজের লোকেরা ওদের সাথে এক টেবিলে বসে খায়, এমনকি কাজের মেয়ে গুলোও ফাতিমার মেয়েগুলোর সাথে এক বিছানায় শোয়।

ফাতিমা দু’হাত ভরে দান করেন। তাও চুপি চুপি, যেন কেও না জানে। ঈদের আগের রাতে গরীবদের বাড়িতে গিয়ে চুপিচুপি নতুন কাপড় দিয়ে আসেন তিনি আর ওদের বলেন “দেখো কাওকে বোল না।”

ফাতিমা জানেন দান এমন ভাবে করতে হয় যেন তার বাম হাতও না জানে।

৩.

আজ ঈদ। সবারই নতুন কাপড় আছে, শুধু সিদ্দিকা আর তার ছোট ভাইবোন দুটোর কাপড় নেই। খাবার বলতে হয় কাচকলা ভর্তা কিংবা বেড়ায় লতিয়ে উঠা সেই পুইশাক ভাজা।

শেষ কোন ঈদে কাপড় কিনেছে ওদের মনে নেই।

কষ্ট হয়, লজ্জা হয়। তবু মনে মনে বলে, “মালিক আমি জানি আপনি সব দেখেন, আমাদের ধৈর্য দিন মালিক।”

৪.

আজ ফাতিমার বড় মেয়ের বিয়ে। বড় গরু আর খাসী কেনা হয়েছে হাট থেকে। আছে কাড়ি কাড়ি মোরগ, মাছ, ডাল, দুধ, মিস্টি, পান-সুপুরী আর কাপড় চোপড়।

বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। মেয়ের রঙ একটু কালো তাই জামাইকে নগদ টাকা আর গয়নাও দিচ্ছে একগাদা। তাও তো খুব ভালো ঘরে বিয়ে হবে মেয়েটার। ৬০০ লোক খেলো বিয়েতে। পুরো এলাকা বললো “বাপের জন্মেও বিয়েতে এমন খাওয়া খাইনি বাপু! ফাতিমা যেমন ধার্মিক মানুষ আল্লাহ্ তাই তাকে অঢেল দিয়েছেনও।”

বড়ো মেয়ের বিয়ের পর ফাতিমার মেজো মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেলো একদিন ধুমধাম করে।

এবার ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে ফাতিমার শান্তি।

ফাতিমার ছোট মেয়ে সিদ্দিকা জেদ করলো সে আরো পড়াশুনা করতে চায়, এখনি বিয়ে করবেনা। শহরে গিয়ে পড়বে।

সিদ্দিকা। যেমন তার রূপ, তেমনি গুন। পড়াশোনায় ফার্স্ট, রান্নায় ফার্স্ট, গানের গলা বলো আর হামদ নাতের গলাই বলো; একবার শুনলে যে কারো চোখে জল আসবে। কবিতা লিখে মেয়েটা আবার খুব দরদ দিয়ে তা আবৃত্তি করে।

শহরে পড়তে গেলো সিদ্দিকা। ভর্তি হলো প্রাইভেট ভার্সিটিতে। ইসলামিক পরিবেশে থাকতে পারবে তাই একটা ইসলামিক ভার্সিটি বেছে নিলো সে।

দিন চলছিলো ভালোই।

হঠাৎই একদিন বিদেশে স্ট্রোক করলো ফাতিমার স্বামী আবার এদিকে ফাতিমার জরায়ুতে ঘা, তলপেটে টিউমার। লাস্ট স্টেজ। অপারেশন করতেই হবে!

একলহমায় যেনো ওদের সাজানো গোছানো পরিবারটা ঝড়ের দাপটে পড়ে উড়ে যেতে লাগলো।

ফাতিমার অপারেশন হলো। তিনি বেঁচে উঠলেন। ফাতিমার স্বামীও আল্লাহর অশেষ দয়ায় বেঁচে উঠলেন। কিন্তু আগের মতো সুস্থ হননি।

যে ক’বছর ফাতিমা আর তার স্বামী অসুস্থ ছিলেন, তখন তার সমস্ত প্রপার্টি দেখাশোনা করতো তার ভাসুর।

একসময় ফাতিমা আবিষ্কার করলেন, পায়ের তলার ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই আর তাদের নেই!

৫.
সিদ্দিকার বয়স বেড়ে যাচ্ছে বিয়ে দেয়া দরকার। ফাতিমা পাত্র খুঁজেন। কিন্তু এই হাভাতের দেশে যৌতুক ছাড়া কে মেয়ে বিয়ে করবে?

হঠাৎ একদিন সিদ্দিকার পরিচিত এক ব্যক্তি তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু যখন শোনে যে যৌতুক দিতে পারবেনা; বিয়েটা পিছিয়ে যায়।

সিদ্দিকার মন খারাপ হয়, সে রোজকার মতো তাহাজ্জুদে জাগে আর বলে “আমি জানি মালিক আপনি আমায় শুনছেন, আমায় এমন একজন মিলিয়ে দিন যার হাত ধরে আমি জান্নাত অবধি যেতে পারি”।

৬.
ভদ্রলোকের সিদ্দিকাকে খুব পছন্দ। না না সিদ্দিকার কবিতা আর গল্প কে। একদিন ফেসবুকের ইনবক্সে বলেই ফেললো বিয়ে করতে চায় সিদ্দিকাকে। সিদ্দিকা বললো, “আমি ধন দৌলত কিছুই চাইনা। শুধু এটুকু আশ্বাস দিতে পারবেন যে আমাকে সাথে নিয়ে জান্নাত অবধি যাওয়ার চেষ্টা করবেন?” ভদ্রলোক হেসে বললেন, “আমি তোমার মতো একজনের জন্যই অপেক্ষা করেছি আর আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি সিদ্দিকা।”

দুই ফ্যামিলীতে কথা হলো। বিয়ে হবে ক’দিন পর। ছেলে যেহেতু দেশের বাহিরে থাকতো সেহেতু ফোনে বিয়ে হবে।

কতো জল্পনা কল্পনা, কতো স্বপ্ন। দিনগুলো যেনো কাটছিলো পাখির ডানায় ভর করে। সিদ্দীকা আল্লাহ্ কে বললো “মালিক আপনি আমার ডাক শুনেছেন”।

কিন্তু হঠাৎ!!! ভদ্রলোক জানালো তার মা অন্য জায়গায় তার বিয়ে ঠিক করেছে। সিদ্দিকাকে বিয়ে করতে পারবেনা।

মেয়েটি হাসি মুখে বললো, “বেশতো। সুখী হোন।”


বাইরে আজ অনেক অন্ধকার। বাবার কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে ক্রমাগত। ব্যাংকের জমানো টাকা ফুরিয়ে এসেছে। যেহেতু ওরা কোনো ইনটারেস্ট বা সুদ নিতোনা ব্যাংক থেকে।

এ মাসের বাড়ি ভাড়া দেয়া হয়নি। ছোট ভাইটার কলেজের বেতন বাকি। ছোট একটা চাকরি মেয়েটার। তাতে চলছেনা। বাবা ক্রমাগত কাশছেই।

মেয়েটার চশমাটা ঝাপসা হয়ে উঠেছে। সে আকাশের দিকে তাকায় আর বলে “ইন্না মা আল উসরি য়ুসরা, আমি জানি রব্বানা আপনি আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। ধৈর্য দিন রব্ব, আমি জানি আমার জন্য কোথাও না কোথাও একটা মানুষকে রেখেছেন, যার পাঞ্জাবীর বুকে আমি আমার চোখের সব জল মুছতে পারবো, ততোদিন আমাকে ধৈর্য দিন মালিক, ধৈর্য দিন।”

………………

সবর
বিনতে আলী

#রৌদ্রময়ী_সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে_গল্প

Original Source

নিয়মিত এরকম গল্প  অগ্রিম পড়তে এই ফেসবুক পেজে লাইক দিন। 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member