একটি বিতর্ক : মূর্তি না ভাস্কর্য ?

বিমানবন্দর গোল চক্করে লালনের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছিল। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বাধার মুখে কর্তৃপক্ষ তা গত ১৫ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে সরিয়ে নেয়। এরপর এ নিয়ে সৃষ্টি হয় তুমুল বিতর্ক। কিছু লোক এটি পুনস্থাপনের পক্ষে আন্দোলন শুরু করে। আবার অনেকে এখানে হজ মিনার নির্মাণের পক্ষে আন্দোলন আরম্ভ করে।

এদিকে কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী বলছেন, ‘বিমান বন্দর গোল চক্করে যা নির্মাণ করা হচ্ছিল ওটা মূর্তি নয়; ভাস্কর্য।’ তারা ‘মূর্তি’ ও ‘ভাস্কর্য’কে আলাদাভাবে সজ্ঞায়িত করতে চান। বুঝাতে চান দুটো এক জিনিস নয়। তাদের কথা, ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ হলেও ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়।

এ বিষয়টি আলোচনা করতে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা হবে :

আভিধানিক অর্থে ভাস্কর্য :

ভাস্কর্য অর্থ : Sculpture (স্কালপচার)। যে আকৃতি বা ছবি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা-ই ভাস্কর্য। যেমন বলা হয় ‘ভাস্কর্য বিদ্যা’ এর অর্থ, The art of carving বা খোদাই বিদ্যা। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছেন তাকে বলা হয় ভাস্কর (Sculptor) অর্থাৎ যিনি খোদাই করে আকৃতি বা ছবি নির্মাণ করেন। যেমন আছে অক্সফোর্ড অভিধানে- One who carves images or figures. অর্থাৎ যে ছবি অথবা আকৃতি খোদাই করে তৈরি করে। পক্ষান্তরে মূর্তি অর্থ ছায়া বা এমন আকৃতি-শরীর, যার ছায়া আছে।

ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেল। এককথায় যে সকল আকৃতি খোদাই করে তৈরি করা হয় তা ভাস্কর্য- রৌদ্র বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া পড়ে না। আর যে সকল আকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, রৌদ্রে বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া প্রকাশ পায়, তা হল মূর্তি। বিভিন্ন অভিধানে এভাবেই বলা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, যে আকৃতিটা বিমান বন্দর গোল চক্করে নির্মাণ করা হচ্ছিল, এ সংজ্ঞার বিচারে তা কি ভাস্কর্য- যেমনটি বলেছেন এর পক্ষের পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীগণ- না মূর্তি- যেমনটি মনে করেছে মাদরাসার মূর্খ (?) অবুঝ ছাত্ররা?

যারা সেটি প্রত্যক্ষ করেছেন নিজ চোখে কিংবা ছবিতে, তারা সকলেই দেখেছেন যে, ওটা এমন আকৃতি যার ছায়া আছে। এবং সেটি কোন কিছুর ওপর খোদাই করে নির্মাণ করা হয়নি। কাজেই বুঝা যাচ্ছে আভিধানিক অর্থে সেটি মূর্তি ছিল; ভাস্কর্য নয়।

এখন প্রশ্ন হল, যে সকল পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবী বলেছেন ওটা মূর্তি নয়; ভাস্কর্য তারা কী ভুল করেছেন? কীভাবে ভুল করবেন? তারা বিমান বন্দরের আশেপাশে অবস্থিত মাদ্রাসার ছাত্রদের থেকে অভিধানে বিষয়ে অনেক বেশি বিজ্ঞ তা বলাই বাহুল্য। (বুদ্ধিজীবীদের ধারণায়) এরা অভিধান দেখে কি-না তাতে সন্দেহ আছে পক্ষান্তরে তারা অভিধান শুধু ঘাঁটেনই না রচনাও করেন।

আমি এর উত্তর খুঁজতে চেয়ে যা বুঝেছি তা হল

এক. সম্ভবত বুদ্ধিজীবীরা ওখানে নির্মিতব্য লালনের আকৃতিটা দেখেননি। তারা মতলববাজ মিডিয়ায় প্রচারিত ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি শুনে মনে করেছেন সত্যিই ওটা ভাস্কর্য- যা কোনো দেয়ালে বা স্থাপনায় খোদাই করে নির্মাণ করা হচ্ছিল।

দুই. তারা মনে করেছেন, যদিও ওটা আভিধানিক অর্থে মূর্তি; ভাস্কর্য নয়। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে ভাস্কর্য। তারা মনে করেছেন, যে সকল আকৃতি পূজা অর্চনার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয় সেগুলোকে মূর্তি বলে। আর যা পূজার জন্য নয়, তার নাম ভাস্কর্য।

তিন. তারা খুব ভাল করেই জানেন যে, ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে আভিধানিক পার্থক্য কী? কিন্তু তারা ওটা নির্মাণের পক্ষে। আর মাদ্রাসার ছাত্ররা যেহেতু এদুয়ের মধ্যকার পার্থক্য বুঝে না, তাই সহজেই তাদের বিভ্রান্ত করা যাবে। বিশ্বাস করানো যাবে যে ওটি আসলে মূর্তি নয়। কাজেই এ নিয়ে তোমাদের প্রতিবাদ বা আন্দোলন করার কিছু নেই। তোমাদের এ আন্দোলন নিছক অর্বাচীনতা বৈ কিছুই নয়।

প্রথম উত্তরের জবাবে বলা যায়, যদি তারা নির্মিতব্য লালন আকৃতিটি না দেখে থাকেন, তাহলে তাদের এ বিষয়ে ফতোয়া দেয়া মোটেই উচিত হয়নি। কোনো বিষয়ে মতামত দিতে হলে ভালভাবে জেনে বুঝে নিতে হয়। এ কথায় তারা ভিন্নমত পোষণ করবেন বলে মনে করি না।

দ্বিতীয় উত্তরের জবাবে বলতে চাই, আপনারা যেমন মনে করেছেন যে, পারিভাষিক অর্থে, যে আকৃতির পূজা করা হয় সেটি মূর্তি। আর যার পূজা করা হয় না সেটি ভাস্কর্য। আপনাদের এ ব্যাখ্যা কোথাও প্রচলিত নয়। যা প্রচলিত নয়, তা কখনো পারিভাষিক অর্থ বলে গণ্য হয় না। বরং ছায়া আছে এমন সকল আকৃতিকে মূর্তি বলে মানুষ জানে ও জানায়। যেমন আমরা দেখেছি যখন লেলিনের দেহটি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলেছে ‘লেলিনের মূর্তি ..’ এমনিভাবে যখন সাদ্দামের আকৃতি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলল, ‘সাদ্দামের মূর্তি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।’ তখন কেউ ভাস্কর্য বলেছে বলে শুনিনি। এমনিভাবে লোকে বলে ফেরআউনের মূর্তি, আব্রাহাম লিঙ্কনের মূর্তি ইত্যাদি। এ দুটো উদাহরণে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, ওই আকৃতিগুলোর ছায়া ছিল ও খোদাই করে নির্মিত নয় বলে ওগুলো মূর্তি। আর ওগুলো পূজার জন্য স্থাপন করা হয়নি, তবু তা মূর্তি। অতএব দেখা গেল, ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থই পারিভাষিক অর্থ হিসাবে প্রচলিত। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। পূজার জন্য হলেও মূর্তি, পূজার জন্য না হলেও মূর্তি। এখানে আমাদের বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের জ্ঞানের দৈন্যতার আরেকটি প্রকাশ! তাদের প্রতি করুণা হয়!

তৃতীয় উত্তরের জবাবে বলব, অন্যকে বোকা বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা কোনো নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। যারা মানুষকে জ্ঞান দিতে চান তাদের থেকে এ ধরনের আচরণ জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

কাজেই বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে যে সকল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে তাকে ভাস্কর্য বলে চালিয়ে দেয়া একটি মূর্খতা, একটি কাপুরুষতা, একটি কপটতা। উদ্দেশ্য হল, ভাস্কর্য শিল্পের নামে ইসলামি সংস্কৃতির বিরোধিতা করা এবং অন্ধকার যুগের পৌত্তলিক সংস্কৃতি-কে বাঙালীর সংস্কৃতি বলে প্রতিষ্ঠিত করা।

লেখক: আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

সম্পাদনা: আলী হাসান তাইয়েব

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

১টি মন্তব্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member