পৃথিবীর বাইরের গল্প

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

হ্যাঁ, জায়গাটা পৃথিবীর বাইরেরই বটে। ছোটবেলায় আমরা একটা ছড়া পড়েছিলাম। শিরোনাম মনে নেই, প্রথম কয়টা লাইন মনে আছে– “এক যে ছিল মজার দেশ সব রকমের ভাল, রাত্তিরেতে বেজায় রোদ দিনে চাঁদের আলো”– এরকম কিছু একটা। মজার ব্যাপার হোল, মজার দেশ কেবল ততক্ষণই মজার থাকে যতক্ষণ সেদেশের অস্বাভাবিকতা চোখে সয়ে আসেনা। অস্বাভাবিকতায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেটাকেই একসময় অতিমাত্রায় স্বাভাবিক মনেহয়। আমাদের কথাই ধরা যাক। সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত গণ্ডির মাঝে আমাদের জীবন চলবে– এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা এখন আমাদের সমাজে অস্বাভাবিক। আর যা কিছু অস্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল, বেশীমাত্রায় তার মাঝে থাকার ফলে সেটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেজন্যই হয়ত আজ যেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে আমি অন্য কোন ভুবনে এসে দাঁড়িয়েছি।

মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা। বিয়েবাড়িতে বা কারুর বাসায় হিজাব পড়ে যাওয়ার সময় মানুষের কত ধরনের মন্তব্য শুনতে হতো। দেখতে হতো “আকাশ থেকে পড়া” মুখভঙ্গি। অনেক সময় হয়ত একা এক কোনায় বসে থাকতাম, আর সবাই বলত কী আজব, ছোট মেয়ে কোথায় সেজেগুজে বেড়াবে তা না, এভাবে বসে আছে… ইত্যাদি কত কথা। তারপর সেই ছোট মেয়ে একদিন বড় হোল, মানুষকে মুখের ওপর বলতে শিখল যে ছোট মেয়েকে যে তার ধর্ম সাজতে বাঁধা দিয়েছিল এমনটা তো কখনো হয়নি… বাঁধা দিয়েছিল “অস্বাভাবিক” সমাজ যেখানে কিনা ছেলে মেয়েদের আলাদা পড়ালেখা, আলাদা অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক আয়োজনের স্থান ছিল না। তারপরও আল্লাহর নিয়ম যে কতটা সুন্দর তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। মনে আছে প্রথমবার মুগ্ধ হয়ে গেলাম সৌদি আরবে মেয়েদের একটি ইউনিভার্সিটি তে ঢুকে। যেখানে অল্প বয়সী মেয়েরা সাজছে, হাসছে, খেলছে– কেউ দেখে ফেলবে এমন ভয়ে গুটিয়ে রাখতে হচ্ছে না নিজেকে, কারণ কেউ দেখবে না। তারা জানে এটা তাদের সাম্রাজ্য, এখানে কোন একজন পুরুষ মানুষও নেই। ওরা নিজেরা জানেও না যে ওরা কত ভাগ্যবতী। হিজাব ওদের অধিকার। অধিকার আদায়ের দায়ে বিভিন্ন দেশের মেয়েদের মত ওদের “অস্বাভাবিক” ভাবে বাঁচতে হয় না। সে যাই হোক, মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের কুরআন শেখার স্কুল, মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকবার যাওয়াতে এসব অনেকটা চোখে সয়েই এসেছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ কথা খুঁজে পাইনি যখন দেখলাম আমার বান্ধবী আমাকে যে পার্কটিতে নিয়ে গিয়েছে সেটি কেবল মহিলা ও শিশুদের জন্য। পুরুষদের সেখানে প্রবশাধিকার নেই!

prithibir bairer golpo

এই পৃথিবীর মাঝে, যেই ইসলামের নামে অপবাদ দেয়া হয় মেয়েদের যথোপযুক্ত অধিকার না দেয়ার জন্য– সেই ইসলামের অনুসারিদের দ্বারা তৈরি একটি শিশু পার্ক যেখানে কেবল মেয়েরা আসতে পারবে, আর আসতে পারবে শিশুরা। ইচ্ছা মত বসতে পারবে গল্প করতে পারবে। কেনাকাটা করবে, খাওয়ার দোকান আছে, কফি শপ আছে আর আছে বাচ্চাদের যাবতীয় রাইড। হিজাব করার পর থেকে জীবনে প্রথম আমি আজকে খোলা আকাশের নিচে হিজাব ছাড়া হাঁটলাম, আর সেই পুরো চারটি ঘণ্টা হিজাব ছাড়া, যেকোনো মুহূর্তে হিজাব পরতে হতে পারে সে আশঙ্কা ছাড়া সেখানে সময় কাটালাম। পৃথিবী যে এতো প্রশস্ত তা যেন আগে কখনো বুঝিইনি। কত স্বাভাবিক, আর সুন্দর একটা ব্যবস্থা! উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বিশাল এক শিশু পার্ক। এতই বড় পরিধি যে যারা ওর ভেতরে আছে তাদের উঁচু পাঁচিলের দরুন নিজেদের “বন্দী” ভাবার মত কোন কারণই ঘটবে না! অথচ কেবল এই ব্যবস্থা করার মত বোধ নেই বলে আমাদের সমাজে কেউ হিজাব করলে তাকে কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হয়। যারা এই কারাগার তৈরি করে নিজেদের বোধহীনতার দরুন, তারাই আবার বলে ” তোমরা নিজেদের অমন বন্দী রেখেছ কেন?”

না। তাদের সৃষ্ট কারাগারে নিজেদের বন্দী রাখতে আমরা হাঁপিয়ে উঠিনি মোটেই। হিজাব আমরা আল্লাহকে ভালবেসে করছি। দুনিয়ার কষ্ট এখানে কোনমতেই প্রাধান্য পায় না। কিন্তু যদি আমাদের একথা শুনতে হয় যে আমরা নিজেদের বন্দী করে রেখেছি, অথবা আমাদের মেয়ে সন্তানদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত রেখেছি, তবে আমরা একথার প্রতিবাদ অবশ্যই করবো। আমাদের অধিকার ছিল কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে সেজে উপস্থিত হওয়ার। অধিকার ছিল অল্প বয়সে হাস্যমুখর পরিবেশে আনন্দে ক্লাস করার। সেই অধিকার ইসলাম আমাদের দিয়েছে। আর আমাদের সেই অধিকার আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে এমন এক সমাজ যেখানে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশাটা এত বেশী মাত্রায় গ্রহণযোগ্য যে হিজাব করা একটা মেয়ে নিজের বিয়ের দিনটাতেও আর সাজতে পারেনা। কারণ তার নিজের পরিবারও ছেলেমেয়ে আলাদা করে অনুষ্ঠান করাটাকে বাহূল্য মনে করে। বুঝে শুনে যে হিজাব গ্রহণ করেছে, তার প্রান থাকতে এবং প্রান চলে গেলেও সে কোনদিন বলবে না যে ইসলাম তাকে বঞ্চিত করেছে। একথা কেবল তারাই বলবে, যারা স্বাভাবিকতার বাইরে বিকৃত এক সামাজিক কাঠামোর ধারক বাহক।

আমি স্বপ্ন দেখি। হ্যাঁ, কারুর স্বপ্ন দেখা কেউ আটকে দিতে পারেনা। তাই আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমাদের দেশে ঘরে ঘরে হিজাবি মেয়েরা থাকবে। তারা এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখবে যেখানে কোন পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই। কারেন্ট চলে গেলে তাদের বোরখার নিচে ঘামতে ঘামতে পরীক্ষা দিতে হবে না কারণ সেখানে পিয়ন থেকে শুরু করে শিক্ষিকা পর্যন্ত সবাই মহিলা। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমাদের দেশের হিজাবি মেয়েরা বিয়ের দিন নিশ্চিন্ত মনে সেজেগুজে বিয়ের আসরে বসবে কারণ শুধু তাদের নিজের পরিবার না, এমনকি শ্বশুর বাড়ির সকলে তাদের হিজাব কে সম্মান করবে। আমি আরও স্বপ্ন দেখি যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের বোনেরা মেয়েদের পার্ক নামক রূপকথার সেই জায়গার খোঁজ পাবে আমাদের নিজেদের দেশেই। আর সেই সাথে আশা রাখি যে সেদিন সেই হিজাবি মেয়েরা তাদের আগে তাদের যে সকল বোনেরা দিনের পর দিন নিজের অধিকার বজায় রাখতে নিজেদের জীবনীশক্তি আল্লাহর পথে সদাকা করেছে– তাদেরকে ভালবাসার সাথে নিজেদের দোয়া তে স্মরণ করবে।

আর যদি এসব স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়, তবু আমি গর্বের সাথে বলতে পারি যে আমার বোনেরা প্রয়োজনে বোরখায় আবদ্ধ হয়ে ঘামতে ঘামতেই পরীক্ষা দিবে, হিজাবি বউরা তাদের বিয়ের দিনও না সেজেই বসে থাকবে, তারা সবার গঞ্জনা সহ্য করে জীবন পার করে দিবে, তবু তাদের হিজাব তারা কোনদিন ত্যাগ করবে না ইনশাআল্লাহ।

রচনাঃ নায়লা নুজহাত

সুত্র

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member