ফিতনার যুগে নিকাব, সহ-শিক্ষা ও দাওয়াত

আমার একজন খুব প্রিয় বোন আছেন। যিনি অনেক উচ্চ শিক্ষিত, দ্বীন পালনে অত্যন্ত আন্তরিক, স্বামী সহ পরিবার নিয়ে দ্বীন পালনে তৎপর শুধু না, সচেতন ভাবে দ্বীনি আন্দোলনের সাথে শরীক। একটা পরামর্শ চেয়েছেন তিনি। বলেছেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জবাব তার জানা আছে। তার স্বামীও এই ব্যাপারে তার সাথে একমত। কিন্তু বুঝতে পারছেন না বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি কি তার বুঝের উপর আমল করবেন, নাকি কোন এক্সপার্ট অপিনিয়ন নেবেন। তিনি অনেক শায়খের সাথে কথা বলবেন, তার ই সুত্রে আমার কাছে নাসীহাহ চাইলেন।

তিনি নিকাব করেন ফারদ্ব মনে করেই। এব্যপারে তিনি খুবই স্পষ্ট। তিনি বালিগ ছেলে মেয়ে একসাথে একই ক্লাশে হিজাব ছাড়া বসে স্টাডী করা হারাম হবার ব্যাপারে এক্কেবারে নিশ্চিত। তিনি আরো উদ্বিগ্ন দেশের পরিস্থিতিতে। তিনি মনে করছেন এমন কি মাদ্রাসার অফিসেও কারো কারো ছবি রাখা আবশ্যক করা হচ্ছে। এই কুফরি- শিরকি- হারামের পরিবেশে এবং নেক্বাবের বিরুদ্ধে করা ঘোষিত যুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কি শিক্ষকতা করবেন?

আমি সোজা সাপ্টা উত্তর দিলাম হ্যাঁ করবেন। আমি জেনে বুঝেই উত্তর দিয়েছি। আমি বেপরওয়া হয়েই বলেছি করবেন। আমি আমার ফতোয়াতে হয়ত ভুল, এটা জেনেও আমি হ্যাঁ বলেছি। আমি জানিনা এতে আমার রাব্ব আমাকে ধরবেন কিনা। এবং এই ফতওয়া দিতে যেয়ে এই পয়েন্টে কেঁদেছি।

আজ বাংলাদেশ শুধু নয়, সারা মুসলিম দেশগুলোতে প্রায় একই অবস্থা। সেখানে সহ শিক্ষা ব্যবস্থা। সৌদিদের হাতে প্রচুর টাকা ছিলো বলে তারা মেয়েদের আলাদা স্কুল করতে পেরেছে, পেরেছে কুয়েত বা কাতার। এইভাবে হাতে গোণা কয়েকটি মুসলিম দেশে ছাড়া সব মুসলিম দেশে সহ শিক্ষা বিরাজিত। ক্লাশের মেয়েরা হিজাব দূরে থাক অধিকাংশ মেয়েরা এখন খুব পাশ্চত্য ধাচের পোশাকে অভ্যস্ত হচ্ছে। অবশ্য যে মেয়েরা হিজাব পরছে, এবং শালীন মডেস্ট পোশাক ও পরছে তাদের সংখ্যা একেবারে কম না। তাছাড়া যে সব মেয়ে শিক্ষকগণ নিক্বাব করেন তাদের হেনস্তা তো আছেই এমন কি নিয়োগ ইন্টারভিউএ নেক্বাব করে গেলে চাকরি হবার সম্ভাবনা খুব কমে গেছে।

এই ক্ষেত্রে অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এই ধরণের ফতওয়াতে হয়ত না করবেন এই বোন কে চাকরি করতে। কিন্তু আমি হ্যাঁ বলেছি।

আমি হ্যাঁ বলেছি, কারণ আমি আমার শক্তিতে খুব দূর্বল। না, ঈমানী শক্তির কথা বলছিনা। বর্তমানে যে জব করি তা যে ঈমান বাঁচাতে, তা আল্লাহই একমাত্র জানেন। আমি বলছি হাতের শক্তির কথা। মানে হাতে এমন শক্তি নেই যে শেখ হাসিনা বা বেগম খালেদা জিয়া বা জেনারেল এরশাদ বা জেনারেল জিয়া বা বংগবন্ধুদের দের বলতে পারতাম সহ শিক্ষা বন্ধ করুন। আর আমার সেই কথা শুনে ও মূসার হাতের লাঠি বা আলো দেখে অমনি তারা মেনে নিতেন। আমি এই কথা বলেছি কারণ আমি ভবিষ্যদ্বানী করতে পারছিনা যে আর মাত্র ১৮ মাস পরে ইসলামি সরকার আসবে। এসেই সব পরিবর্তন করে ফেলবে। তখন বোন তুমি চাকরি করো। আলিমগণের অনৈক্য, দ্বীনের ব্যাপারে মুসলিম জাহানের অনিহা, মুসলিম নেতৃবৃন্দের পাশ্চত্য তোষামোদী ও তাদের ইসলাম বিরোধিতা দেখে বরং আমার কাছে মনে হচ্ছে আমাদের এই দ্বীনহীন অবস্থা কয়েক জেনারেশান ধরে চলবে। এখন আমাদের বর্তমান সিচুয়েশানে কাজ করতে হবে, এবং এই সব কাজের মাধ্যমেই আমাদের সিচুয়েশান বদলাতে হবে। এটাকেই আমাদের নবী (সা) সিস্টেম পরিবর্তন করার বিপ্লবের তৃতীয় পদ্ধতি “ফা বি ক্বালবিহী” বলে উল্লেখ করেছেন।

তূর্কীরা যখন মারাত্মক সেক্যুলারের জ্বালে আটকা পড়ে, তাদের কে তা থেকে বের করার প্রাণ পুরুষ ছিলেন সাঈদ নূরসী। তিনি ছাত্র তৈরি করেছিলেন, রিসালাতুন নূর লিখেছিলেন এবং কিছু খলিফা রেখে গিয়েছেন। যাদের হাতে তুরস্ক এখন ইসলামের দিকে মুখ ফেরাতে যাচ্ছে। যদিও সে পথ পরিক্রমা অনেক রক্তের দাবী করতেছে। ফেতুল্লাহ গুলেন এই যুগের একজন মনিষী। মাঝে এরদোয়ানের সাথে গন্ডোগোল না লাগলে বলা যায় তিনি হতেন তুরস্কের সেরা স্কলার হিসাবে গন্য। যাহোক তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জুডিশিয়ারী, আর্মী, পুলিশ বাহিনী, সাংবাদিকতা ও মিডীয়াতে ইসলামের বীজ বপন করতেছিলেন সেই ১৯৮০ এর পর থেকে। তখন তিনি এই ফতওয়া গুলো দিতেন। বলতেন, দেখ তোমরা যারা খাঁটি মুসলিম আছো ওরা যদি এই সব যায়গায় না যাও তাহলে কখনোই সেখানে ইসলাম পৌঁছাতে পারবেনা। ব্যাংকে যাও। আর্মীতে যাও। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও। আমার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পাশ্চত্য থেকে ভালো ভালো ডিগ্রী নিয়ে এসে ঐ সব যায়গায় ঢুকে পড়ো। তানা হলে ইসলামের শত্রুদের হাতে ঐগুলো থেকেই যাবে।

আমি এই ধরণের বোনদের বলবোঃ বোন নিক্বাব ইস্যুতে বাড়াবাড়ি না করি। যারা ফারদ্ব মনে করেন, ঠিক আছে, না করবোনা। তবে যারা ফারদ্ব মনে করেন না তাদের কেও আমি ছোট করবোনা। কারণ ফতওয়া উভয় পক্ষেই আছে। আমি নিক্বাব যারা পরেন তারা যে বেশি সাওয়াব পাচ্ছেন এব্যপারে নিশ্চিত।

আমি লন্ডনে মেইনস্ট্রীম কলেজে পড়িয়ে দেখেছি যথেষ্ঠ প্রভাব ফেলা যায় ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে। লেইটন সিক্সথ ফরমে পড়ানোর সময় শুধু একদিন বলেছিঃ তোমারা ছেলেরা এই দিকে ও মেয়েরা ঐদিকে বসলে মাইন্ড করবে? আমি তো দেখেছি এক খৃষ্টান মেয়ে আরো খুশি হলো এতে। আমি তো দেখেছি দ্বীনের দাওয়াত লেসনের ফাঁকে ফাঁকে যেভাবে আমি দিতে পেরেছি এদের অন্য কোথাও সেভাবে পারিনি। এক মুসলিম মেয়ে দেখতাম খুব উগ্র পোশাক পরে আমার ক্লাশে আসতো। ইয়েমেন এ বাড়ি। একদিন ক্লাশে ইয়ামানের সোনালী ইতিহাস নিয়ে একটা এসাইনমেন্ট দেই। পরের সপ্তাহে সে আদনান, ক্বাহতানের গৌরব গাঁথার সাথে নিয়ে এলো সাবার রাণী বিলক্বিসের জীবন বৃত্তান্ত। আবরাহার কুখ্যাত হাতি বাহিনীর বর্ণনা সে বিবমীষার সাথেই বর্ণনা করে একটা হাদীস দিয়ে শেষ করলোঃ একবার ইয়ামানের কিছু লোক মহানবী (সা) কাছে এলেন, তাদের লক্ষ্য করে তিনি বললেনঃ তোমাদের মাঝে ইয়ামানের লোকেরা এসেছে। তারা মনের দিক দিয়ে অত্যন্ত নরম, আর হৃদয়বৃত্তিতে তারা কোমল। মনে রেখ ঈমান তো ইয়ামানী ঈমান, আর প্রজ্ঞা সেতো ইয়ামানের ই। বুখারী ৪৩৮৮, মুসলিম ৫২।

আমি থ’ হয়ে থাকলাম এই উদ্ভিন্ন যৌবনা অষ্টাদশী “হাজারের” কান্নার গমকে। আমি ৩ বার এই হাদীস উচ্চারণ করলাম। আর বসে থাকা উর্বশির নতশীরের দিকে তাকিয়ে দুয়া করলাম। এরপর দিন থেকেই সে ছিলো পূর্ণ হিজাবী। সে আজ ৯ বছর হয়ে গেছে। এখন সে লন্ডনের এক মুসলিম স্কুলের হেড টিচার। আমি তার মেসেজ পড়ি আর মন ভরিয়ে ফেলি দাওয়াতের সফলতায়।

ফাতওয়ার মূল কথা হলোঃ জাহেলিয়্যাত সে সব যায়গা গুলো দখল করে নিয়ে আজ শয়তানের রাজত্ব তৈরী করে ফেলেছে, ইসলাম পন্থীদের প্রজ্ঞার ব্যবহার করে সে সব স্থানে পৌঁছতেই হবে। যেভাবেই হোক। অনেকে বলেন বিকল্প তৈরী করো। আমি বলি মুসলিম বিশ্বে এসব গুলো আমাদেরি সম্পত্তি। ওর বিকল্প কেন। ঐখানেই যাও। যোগ্যতা নিয়ে যাও। ডিগ্রী নিয়ে যাও।

ডিগ্রী, ভালো রেজাল্ট ও যোগ্যতার কি মূল্য তা আমাদের শায়খ নাসের উদ্দীন আলবানীকে দিয়ে দেখেছি। এত যোগ্যতা থাকা সত্বেও তাকে মদীনা ইউনিভার্সিটিতে তে থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ না থাকায়। আমাদের ভাই বোন দের সে যোগ্যতা নিয়ে উঠতে হবে।

আমরা যখন আই আই ইউ সি থাকতাম, তখন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক নিতে যেয়ে দেখেছি আমাদের ইসলাম পন্থী শিক্ষকদের কেমন দৈন্য দশা।

সংগৃহীত।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88