ডাক্তারি পড়া ও হাসপাতালে চাকুরী করার হুকুম কি

প্রশ্ন: আমরা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। আমরা জানতে চাচ্ছি, যেসব হাসপাতালে নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে কাজ করে, পুরুষ ডাক্তার নারী-পুরুষ সকলকে সমানভাবে চিকিৎসা সেবা দেয়; তবে নিষিদ্ধ নির্জনবাস এড়িয়ে চলা সম্ভব। আপনাদের দৃষ্টিতে সেখানে চাকুরী করার শরয়ি হুকুম কি? আমাদের দেশের সকল হাসপাতালে একই নিয়ম। তাই কোন মুসলিম ডাক্তারের পক্ষে শুধু পুরুষদের জন্য খাস এমন কোন হাসপাতালে চাকুরী করার সুযোগ নেই; কারণ এমন কোন হাসপাতাল আমাদের দেশে নেই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, উল্লেখিত সিস্টেমের কারণে একজন মুসলিম ডাক্তার ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিলে এতে মানবসেবা বিঘ্নিত হবে এবং এসব হাসপাতালে চাকুরী করার চেয়ে অধিক অকল্যাণ সাধিত হবে। এ ইস্যু নিয়ে আমরা খুব চিন্তার মধ্যে আছি। এ প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। আশা করি আল্লাহ আপনাদের মাধ্যমে আমাদেরকে সঠিক পথ দেখাবেন।
উত্তর:
আলহামদুলিল্লাহ।

এক:

আমরা আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, এমন একটি মাসয়ালার শরয়ি হুকুম জিজ্ঞেস করার জন্য, বর্তমানে যে সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আমরা আমাদের জন্য ও আপনাদের জন্য কথা ও কাজে তাওফিক প্রার্থনা করছি।

দুই:

কোন পুরুষ ডাক্তারের জন্য মহিলাদের চিকিৎসা করা জায়েয নয়। তবে যদি মুসলিম কিংবা অমুসলিম মহিলা ডাক্তার না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে জায়েয হবে। এ বিষয়ে ‘ইসলামী ফিকাহ একাডেমি’ থেকে একটি সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে রয়েছে: “শরিয়তের মূল বিধান হচ্ছে- বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তার মহিলা রোগীর চেক-আপ করবেন। যদি মুসলিম মহিলা ডাক্তার না পাওয়া যায় তাহলে বিশ্বস্ত অমুসলিম মহিলা ডাক্তার মহিলা রোগীর চেক-আপ করবেন। যদি অমুসলিম মহিলা ডাক্তারও না পাওয়া যায় তাহলে মুসলিম পুরুষ ডাক্তার মহিলা রোগীর চেক-আপ করবেন। যদি মুসলিম ডাক্তারও না পাওয়া যায় তাহলে অমুসলিম পুরুষ ডাক্তার সে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে শর্ত হল, পুরুষ ডাক্তার রোগিনীর শরীরের ততটুকু দেখবেন যতটুকু দেখা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার স্বার্থে প্রয়োজন; এর বেশি দেখবে না এবং সাধ্যমত দৃষ্টি অবনত রাখবে। পুরুষ ডাক্তারকে রোগিনীর চিকিৎসা করতে হবে রোগিনীর মোহরেম কিংবা স্বামী কিংবা কোন বিশ্বস্ত নারীর উপস্থিতিতে; যাতে করে নিষিদ্ধ নির্জনবাস না ঘটে।”

এছাড়া একাডেমির পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত পরামর্শ দেয়া হয়:

“মেয়েদেরকে মেডিকেল সাইন্সে ভর্তি হতে এবং চিকিৎসার সকল শাখায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জন করতে স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্তৃপক্ষকে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়োজিত করতে হবে। বিশেষতঃ মেয়েলি রোগ ও প্রসূতিবিদ্যার ক্ষেত্রে। যেহেতু চিকিৎসার এ বিভাগগুলোতে মহিলা ডাক্তারের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যাতে করে, (মহিলা ডাক্তারের অভাবে) এ ক্ষেত্রগুলোকে আমরা মূল বিধানের ব্যতিক্রম অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য না হই।[একাডেমীর জার্নাল থেকে সংকলিত (৮/১/৪৯)]

এ সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তরগুলোর জবাব দানে আমরা ফিকাহ একাডেমীর এ সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করেছি। যেমন দেখুন: 2152 নং ও 20460 নং প্রশ্নোত্তর।

তিন:

যদি কোন মুসলিম দেশের সবগুলো হাসপাতালতে নারী-পুরুষের মিশ্রিত অবস্থা বিরাজ করে; তাহলে এটি একটি দুঃখজনক বিশেষ বাস্তবতা। সেক্ষেত্রে পূর্বোক্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর নয়। কারণ মহিলা রোগীদেরকে কিংবা একটা বড় সংখ্যক মহিলা রোগীকে এ হাসপাতালগুলোতে যেতে হবে এবং পুরুষ ডাক্তারদের কাছে নিজেদেরকে পেশ করতে হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই, যদি দ্বীনদার ডাক্তারদেরকে এ সকল হাসপাতালে চাকুরী করতে নিষেধ করা হয় তাহলে গোটা ময়দান বেদ্বীন ডাক্তারদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়বে; যারা তাদের চাকুরীর ক্ষেত্রে, দৃষ্টির ক্ষেত্রে কিংবা নির্জনবাসের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে না। অনুরূপভাবে দ্বীনদার ডাক্তারগণ চাকুরীর সুযোগ হারাবেন। কিংবা মেডিকেল কলেজগুলো দ্বীনদার ও সৎ মানুষ থেকে খালি হয়ে যাবে। কোন সন্দেহ নেই এতে রয়েছে মহা ক্ষতিকর অনেক বিষয়। যে ক্ষতিগুলো কোন পুরুষ কর্তৃক মহিলার সতর দেখার চেয়ে অনেক মারাত্মক হতে পারে; প্রয়োজন ও জরুরী মুহূর্তে শরিয়তে যা দেখার বৈধতা রয়েছে।

আমাদের নিকট যা অগ্রগণ্য প্রতীয়মান হচ্ছে তা হল –আল্লাহই ভাল জানেন- এ ধরণের হাসপাতালগুলোতে আপনারা চাকুরী করতে কোন আপত্তি নেই। তবে, এ বাস্তবতাকে পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এমন কিছু প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে যেগুলোতে নারী-পুরুষের মিশ্রণ থাকবে না। এবং কিছু মহিলা হাসপাতাল চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষকে রাজি করানো ও প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাতে হবে, যে হাসপাতালগুলোতে শরয়ি নীতিমালা মেনে চলা হবে, যেমন- নির্জনবাস এড়ানো, শুধু প্রয়োজনের স্থানটুকুতে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখা ইত্যাদি যে বিষয়ে 5693 নং প্রশ্নোত্তরে উল্লেখ করা হয়েছে।

আমাদের এ জবাবটি দুটো মৌলিক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল:

১. আলেমগণের নিকট স্বতঃসিদ্ধ নীতি হচ্ছে- ইসলামী শরিয়ত কল্যাণ সাধন কিংবা কল্যাণকে পরিপূর্ণতা দিতে এসেছে এবং অকল্যাণকে প্রতিহত করা কিংবা হ্রাস করার জন্য এসেছে। তাই বড় অকল্যাণকে দূর করার জন্য ছোট অকল্যাণে লিপ্ত হওয়া জায়েয।

২. এটি প্রথম নীতির শাখাতুল্য। যেসব পেশায় চাকুরী করা নিষিদ্ধ কোন কোন আলেম সাধ্যানুযায়ী মন্দকে হ্রাস করার জন্য সেসব পেশায় চাকুরী করা জায়েয ফতোয়া দিয়ে থাকেন। যেমন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) ফতোয়া দিয়েছেন: যে ব্যক্তিকে সরকারী কোন পদে নিয়োগ দিয়ে জনগণ থেকে মুকুস (হারাম ট্যাক্স) আদায়ে তাকে বাধ্য করা হয়, কিন্তু সে ব্যক্তি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ও যুলমকে প্রতিহত করার ও যতদূর সম্ভব মুকুস (হারাম ট্যাক্স) কমানোর সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে। যদি তিনি এ পদ ছেড়ে দেন তাহলে এমন ব্যক্তি পদটি দখল করবে যে মানুষের উপর আরও বেশি যুলুম করবে। সে ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিনি ফতোয়া দেন যে, এমন ব্যক্তির জন্য এ পদে বহাল থাকা জায়েয। বরঞ্চ তার চেয়ে উত্তম কোন ব্যক্তি যদি পদটি গ্রহণ না করে তাহলে তার জন্য এ পদে বহাল থাকা পদ ছেড়ে দেয়ার চেয়ে উত্তম। তিনি বলেন: “কখনো কখনো এ পদে বহাল থাকা তার উপর ফরজও হতে পারে; যদি অন্য কেউ দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম না হয়। কারণ সাধ্যানুযায়ী ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ও যুলুমকে প্রতিহত করা ফরজে কিফায়া। প্রত্যেক ব্যক্তি তার সক্ষমতা অনুযায়ী এ ফরজিয়ত আদায়ের চেষ্টা করবে; যদি তার পক্ষ থেকে অন্য কেউ সে দায়িত্ব পালন না করে।[মাজমুউল ফাতাওয়া (৩০/৩৫৬-৩৬০) থেকে সংকলিত]

জ্ঞাতব্য হচ্ছে- মুকুস (হারাম ট্যাক্স) আদায় করা মারাত্মক হারাম। এটি কবিরা গুনাহ। কিন্তু একজন নেককার মুসলিমের এ পদের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যে যেহেতু সাধ্যমত অকল্যাণকে হ্রাস করা ও সীমিত করার সুযোগ রয়েছে তাই তার জন্য এটি জায়েয হবে।

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) শাইখুল ইসলাম (রহঃ) এর একটি বাণীর উপর সংযোজন করতে গিয়ে বলেন: “সাধারণ কল্যাণকে রক্ষা করতে হবে। উদাহরণতঃ আমরা যদি ডাক্তারিবিদ্যা ছেড়ে দিতে বলি এবং ভাল লোকেরা ডাক্তারিবিদ্যা অর্জন না করে; বলে যে, আমরা কিভাবে চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করব; আমাদের পাশে থাকে মহিলা নার্স, শিক্ষার্থী, ইন্টার্নী ডাক্তার? আমরা বলব: আপনি যদি এ ডাক্তারিবিদ্যা অর্জন করা থেকে বিরত থাকেন তাহলে এ বিদ্যার ময়দান কি খালি থাকবে? অচিরেই খারাপ লোকগুলো এ ময়দান দখল করে নিবে এবং জমিনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিবে। বরং আপনারা একজন, দুইজন, তিনজন, চারজন যদি একত্রিত হন আশা করি এমন একদিন আসবে যেদিন আল্লাহ তাআলা রাষ্ট্রপ্রধানকে হেদায়েত দিবেন এবং তিনি মহিলাদের জন্য আলাদা ও পুরুষদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করবেন।” [শারহ কিতাবুস-সিয়াসা আল-শারইয়্যা, পৃষ্ঠা-১৪৯]

শাইখ উছাইমীনকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, “আমরা একদল ডাক্তার রিয়াদে চাকুরী করি। আমাদের ডিউটিকালে পুরুষ ও মহিলা রোগী আসে। কখনো কখনো কোন মহিলা রোগী মাথা ব্যথা বা পেটে ব্যথার কথা বলেন। পরিপূর্ণ চিকিৎসার দাবী হচ্ছে- রোগিনীকে পরীক্ষা করে দেখা। পরীক্ষার মাধ্যমে মাথা ব্যথার কারণ নির্ণয় করা। রোগের কারণ নির্ণয় করতে গেলে রোগীর পেট কিংবা মাথা কিংবা অন্য কোন অঙ্গ পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়; যাতে করে ডাক্তারের উপর কোন দায় না আসে। আর যদি রোগিনীকে পরীক্ষা করা না হয় হতে পারে এতে করে রোগিনী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে পরীক্ষা না করারও সুযোগ আছে। তবে যথাযথ কনসালটেন্সির করতে গেলে পরীক্ষা করা প্রয়োজন…।

শাইখ জবাবে বলেন:

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হচ্ছে- পুরুষ ডাক্তার ও মহিলা ডাক্তারের মাঝে এমনভাবে ডিউটি ভাগ করে দেয়া যাতে করে মহিলা রোগী আসলে তাদের চেক-আপ করা ও পরীক্ষা করার জন্য মহিলা ডাক্তারের কাছে পাঠানো যায়। যদি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ কর্তব্য পালন না করে, এ বিষয়ে ভ্রূক্ষেপ না করে তাহলে মহিলাদের চিকিৎসা করায় আপনারা গুনাহগার হবেন না। তবে শর্ত হচ্ছে- চিকিৎসাকালে কোন মহিলা রোগীর সাথে নির্জনবাস না ঘটা এবং যৌন উত্তেজনা না আসা এবং প্রকৃতপক্ষে রোগীকে পরীক্ষা করার প্রয়োজন থাকা। যদি পরীক্ষা করার প্রয়োজন না থাকে, কিংবা সূক্ষ্ম পরীক্ষা পরবর্তীতে মহিলা ডাক্তার আসার পর করলেও চলে তাহলে সে পরীক্ষা পরবর্তীতেই করতে হবে। আর যদি দেরী করার সুযোগ না থাকে; তাহলে এটি প্রয়োজন। এমতাবস্থায় পুরুষ ডাক্তার মহিলা রোগীর চিকিৎসা করলে গুনাহ হবে না।[লিকাআতুল বাব আল-মাফতুহ (১/২০৬)]

আমরা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মুসলমানদের পরিবেশ-পরিস্থিতি শোধরে দেন। আমাদেরকে প্রকাশ্য ও গোপন সকল ফেতনা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, নিকটবর্তী ও দোয়াতে সাড়াদানকারী।

আল্লাহই ভাল জানেন।

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
skybet88 skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 slot bonus new member skybet88 skybet88 slot gacor skybet88 skybet88