এক গোনাহগারের প্রত্যাবর্তন এবং আল্লাহর করুণা

আপনি দুনিয়ার পেছনে ছুটছেন? কতটুকু ছুটবেন? নারীর পেছনে ছুটছেন? কতটুকু ছুটবেন? আমি আব্দুল্লাহ যতটুকু দুনিয়ার পেছনে ছুটেছি, যতটুকু নারীর পেছনে ছুটেছি তার থেকেও বেশি ছুটতে পারবেন? হ্যাঁ, এই ছোটো পরিসরে আমি আজকে আপনাদের সাথে ভাগ করে নেবো আমার সেই অন্ধকার জীবনের কথা এবং আলোর পথে ফিরে আসার কথা।

২০০৯ সালে আমি ক্বওমী মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত ছিলাম। মাওলানা হতে বাকি ছিলো পাঁচ বছরের মত। কিন্তু সে সময় শয়তানের কবলে পড়ে দুনিয়াবি লালসায় ক্বওমীর পাশাপাশি আমি ভর্তি হই একটি সরকারি মাদ্রাসায়। আমি ক্রমেই আল্লাহ প্রেম ভুলে প্রার্থিব প্রেমে মত্ত হয়ে যাই।

২০১১ সালে দাখিল পাশ করে আমি ভর্তি হই স্থানীয় নামকরা একটি কলেজে। পতনের শুরু এখান থেকেই। কলেজে আমার কিছু ছেলে বন্ধু জুটে যায় অল্প কয়েক দিনেই। তারপর আরো কয়েকদিন যেতে মেয়ে বন্ধুও জুটে কিছু। জাহান্নামি পরিবেশ বলতে যা বুঝায় সেরকমই একটা পরিবেশ। যেটা আমাকে আল্লাহর থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। তবে সেটা অযাচার পর্যায়ের মত কিছু না। ছেলে-মেয়ে মিলে সাধারণ আড্ডাবাজি পর্যায়ের। তবে সেটাই জাহান্নামি পরিবেশ নয় কি যেখানে ছেলে-মেয়ে পর্দার পরোয়া না করে প্রেমের গল্প করে?

কলেজে রেগুলার ছিলাম না আমি। কারণ, তখনও আমি কলেজের পাশাপাশি ক্বওমী মাদ্রাসায় পড়ছি। যেহেতু কলেজে রেগুলার ছিলাম না তাই পড়া-শোনার জন্য আমি একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই। এখানেও কিছু আড্ডাবাজ বন্ধু জুটাই। যারা আমাকে শিখয়েছে “ফ্রেন্ড ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল” ডায়ালগ। যারা আমাকে শিখয়েছে “ধর্ম যার যার উৎসব সবার” স্লোগান।

এ যাবৎ খুব খারাপ যাচ্ছিল না আমার। কিন্তু খারাপটা হলো যখন “রিমি” (নকল নাম) মেয়েটা ভর্তি হলো আমাদের কোচিংয়ে। বেশ ভালো এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো। অসম্ভব রূপসী মেয়েটির রূপে মত্ত হয়েছিল ক্লাসের প্রায় প্রতিটা ছেলেই। কিন্তু মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড হওয়ার কারণে আমি তখনও কিছুটা লাজুক ছিলাম। আমি মেয়েটির থেকে দূরে দূরেই থাকতাম। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়! মেয়েটি আমাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে এবং অনেক অনেক কাহিনীর পর সেই বিশ্বাস প্রেমে রূপ নেয়!

এ কাহিনী বলা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, এ প্রেম এতটাই গভীর রূপ নিয়েছিল যে, আমি তাকে ছাড়া এবং সে আমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারতাম না। আমি এতটাই পাগল হয়েছিলাম যে, বখাটেদের মত একবার হাত কেটে রক্ত দিয়ে চিঠি লিখেছিলাম! সহীহ পাগলামি প্রেম যাকে বলে আরকি!

২০১৩ তে এইচএসসি পাশ করলাম আমি। আর পাশ করার কয়েকদিন আগেই রিমির সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়া হয় নাটকীয় ভাবে। এতে আমি কিংবা রিমি জড়িত ছিলাম না। কিংবা সে জড়িত থাকলেও আমি জানি না। এ সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর থেকে আমি এতটাই ভেঙে পড়ি যে আমি কয়েকবার আত্মহত্যার চিন্তাও করেছিলাম! যদিও সেটা সম্ভব না আমার দ্বারা। কিন্তু হতাশা আমাকে এতটাই চেপে ধরেছিলো! আমি বেঁচে ছিলাম রিমির দেয়া কিছু উপহার আঁকড়ে ধরে। প্রায় দু’বছর আমি প্রায় প্রতি রাত কেঁদেছি রিমির দেয়া চিঠি বুকে জড়িয়ে!

কিন্তু এইতো সেদিন আমি হঠাৎ করেই নর্দমায় ফেলে দিলাম আমার এতদিন আঁকড়ে থাকা হারাম জাহান্নামি প্রেমের সমস্ত স্মৃতি! কেন? কারণ, আমি খুঁজে পেয়েছি আমার প্রকৃত প্রেম। আল্লাহ প্রেম। আমার প্রকৃত ঠিকানার সন্ধান আমি পেয়েছি। জান্নাত। আমি ভয়ে কেঁপেছি আমার অন্ধকার দিনগুলো স্মরণ করে। আমি অশ্রু ঝরিয়েছি অঝোরে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

২০১৪ এর শেষ দিকে আমি ভর্তি হই একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। প্রেমের ইতি হয়েছে এক বছর আগেই। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে লক্ষ্য ছিলো একটাই। চাকরী করে অনেক অনেক টাকা বানিয়ে আমি দাঁড় করাব নিজেকে। টাকার পাহাড় বানিয়ে তবেই ক্ষান্ত হব আমি। পারলে কোনোদিন রিমির পরিবারের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। প্রমাণ করব নিজেকে!

ভার্সিটিতে ঢুকেও অনেক বন্ধু পেলাম। দুনিয়াবি বন্ধু। কিন্তু তার মাঝেই পেলাম দুজন বন্ধু। Hasan Kazi আর Syed Minhazul Abedin Maher। দ্বীনি বন্ধু। যাঁরা স্কুল-কলেজে পড়েও আল্লাহকে চিনে ফেলেছে! আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে গেছে! আমি খুঁজে পেলাম যে, এদের জাগতিক চাহিদা নেই। এরা এই ভার্সিটিতেও আল্লাহকে মেনে চলছে! ছেলে-মেয়ের অবাধ আড্ডার জগতেও এরা চোখ নিচু করে হাটছে। 

মসজিদে আল্লাহর কাছে চোখের অশ্রু ফেলছে! আমি মাদ্রাসার ছাত্র। আল্লাহকে ভুলে থাকলেও আল্লাহ প্রেম অন্তরের কোটরে ঘুমন্ত অবস্থায় গেঁথেই তো ছিলো। এদের চলা-ফেরা আমাকে আমার পুরোনো জীবন মনে করিয়ে দিতে লাগল। এদের সাথে উঠা-বসা করতে গিয়ে আমি ধীরে-ধীরে ফিরে পেতে থাকলাম আমার হারানো স্বত্বা! জেগে উঠতে লাগলো মাদ্রাসার সেই ছোট্ট বালকটির স্বপ্ন। যে স্বপ্ন দেখত এ যুগের হযরত বাইয়মপূরী (রহঃ) হবে সে।

এদের মধ্যেই এক বন্ধু একদিন একটি ভিডিও দিলো আমাকে। শায়খ হাসান আলির একটি শর্ট রিমাইন্ডার। আমি শায়খ হাসান আলিকে চিনি না। আমি চিনি জেনিফার লোপেজ, জাস্টিন বিবার, এমিনেম, পিটবুল, টেলর সুইফট সহ অসংখ্য জাহান্নামিদেরকে। এদের সাথেই আমার উঠা-বসা! এদের সাথেই দিন-রাত! আস্তাগফিরুল্লাহ!!! আল্লাহ তা’লার অসংখ্য শুকরিয়া যে তিনি আমাকে এই জাহান্নামিদের হাত থেকে, শয়তানের এই প্রতিনিধিদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন!

একদিন রাত্রে আমি হাসান আলির সেই ভিডিও ক্লিপটি অপেন করি। ভিডিওর নাম “ডেথ এক্সপেরিয়েন্স”। আমি ভিডিওটি দেখতে থাকি। আমার শরীর কাঁপতে শুরু করে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে বইতে শুরু করে। আমি থেমে থাকতে পারি না! আমি দৌড়ে জায়নামাজ নিয়ে আসি। আমি নামাজে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকি! কাঁপতে থাকি। ক্ষমা পেতে মরিয়া হয়ে কাঁদতে কাঁদতে জীবনের দীর্ঘতম সেজদা দেই। আমি ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করি! আমি ফিরে আসি। আমি ছুড়ে ফেলি এতদিনের আঁকড়ে থাকা সব হারাম সম্পর্কের স্মৃতি। ছুড়ে ফেলি ৪-৫ বছর ধরে আঁকড়ে ধরে থাকা জাহান্নামি স্মৃতি। আমি ডিলেট করি আমার ১০০০ এর বেশি গানের সম্ভার আর যাবতীয় জাহান্নামি ভিডিও।

আমি আল্লাহর প্রেমে পড়ি। আল্লাহর পথে ফিরে আসি। আমি সেজদায় পড়ি। সেজদাই আমার শান্তি। আমি শান্তি ফিরে পাই। আর উপভোগ করি আল্লাহর রহমত। শুনবেন আল্লাহর একটি ছোট্ট করুণার কথা?

আমি এবারই আমার ভার্সিটি লাইফে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করি। অথচ এবার আমার সবচাইতে খারাপ রেজাল্ট হওয়ার কথা ছিল। আমি এবার মিডটার্মে খুব বেশি খারাপ রেজাল্ট করি। বাকি ছিল ফাইনাল! আমি এতটাই হতাশ ছিলাম যে, আমি ভেবেছিলাম আমি ফেল করব। কিন্তু আল্লাহর কসম, যখন আপনি আল্লাহর দিকে ফিরে আসবেন তখন আল্লাহর সাহায্য আসবেই। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি আল্লাহর পথে ফিরে আসার পর আমার এ হতাশা কেটে যায়! আমি আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেই সবকিছু। পাশ অথবা ফেল কিছুই মনে হয়না আমার কাছে। আমি পরীক্ষার পড়া থেকে বেশি গুরুত্ব দেই আল্লাহর সেজদাকে। আমি সেজদা দিতে থাকি।

পরীক্ষার আগের রাত্রে যখন পড়তে বসলাম, বিশ্বাস করুন, সেই অঙ্ক গুলোই দেখার সাথে সাথে আমার মুখস্থ হয়ে যেতে লাগলো যেগুলো আমি রাতের পর রাত পড়েও বুঝতে পারিনি! সব গুলো সাবজেক্ট এত সহজেই বুঝে আসতে শুরু করল যে আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম! আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সুবহানাল্লাহ। আমি আমার কান্না আটকে রাখতে পারিনি। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে ভুলিনি।

আমি পরীক্ষার হলে গিয়েও আমার কান্না আটকে রাখতে পারিনি। যে আমি অঙ্কের ‘অ’ লিখতে গেলেও ‘থ’ হয়ে বসে থাকতাম, পরীক্ষা দিয়ে এসে বাসায় বালিশ ভেজাতাম, সেই আমি প্রশ্ন কোনটা রেখে কোনটা আনসার করব ভেবে পাচ্ছিলাম না! সবগুলো সাবজেক্ট এর প্রশ্ন দেখেই আমার এরকমই মনে হয়েছিল। ফলাফল তদ্রূপই হয়েছে। যে পরীক্ষায় ৩৭ আনসার করেছি সেটায় পেয়েছি ৩৭। যেটায় ৩৮ করেছি সেটাতে ৩৮। যেটাতে ৩৫ করেছি সেটাতে ৩৫! চারটা সাবজেক্টের ৩ টাতে আল্লাহ দিয়েছেন A+ আর একটাতে A (মিডে এই সাবজেক্ট অসম্ভব খারাপ করেছিলাম)!

লেখাতে বাহুল্য খুব বেশি করে ফেলেছি! বাহুল্যের পেছনে লক্ষ্য একটাই। আপনাকে এই মেসেজটাই দিতে চাই, আপনি ফিরে আসুন আল্লাহর পথে। আল্লাহর রহমত ২০১৫ সালে কমে যায়নি। ১১০০০০০০ বিধর্মীকে মুসলিম বানানোর পথে আব্দুর রহমান বিন সুমাইত (রহঃ) একবার আফ্রিকার একটি গ্রামে ইসলামের দাওয়াত দিতে গেলে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি! তাকে বলা হয়, “তোমার আল্লাহকে বলো বৃষ্টি দিতে। যদি বৃষ্টি আনতে পারো তবেই তুমি গ্রামে ঢুকতে পারবে!” 

বাধ্য হয়ে আব্দুর রহমান (রহঃ) আল্লাহর কাছে অশ্রু ঝরিয়ে কাঁদতে থাকেন! আকাশ কালো হতে থাকে! আব্দুর রহমানের (রহঃ) চোখের পানির অঝোর ধারার সাথে আকাশ থেকেও বৃষ্টি পড়েছিল অঝোর ধারায়! মুসলিম হয়েছিল পুরো গ্রামের মানুষ! আল্লাহ তাঁর রহমত ২০১৫ সালেও কমিয়ে দেননি। সেই আল্লাহর ক্ষমা করার গুণও চিরন্তন অটুট। 

আল্লাহর দরবার সবসময় বান্দার জন্য উন্মুক্ত। আল্লাহর কাছে সেই বান্দাই প্রিয় যে গোনাহ করল কিন্তু গোনাহের মধ্যে ডুবে না থেকে আল্লাহর কাছে ফিরে আসল। তাওবা করল। ৯৯ খুন করার পরেও আল্লাহর বান্দাহকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আপনি কতটুকু গোনাহ করেছেন সে তুলনায়?

তাওবা করুন। সিজদা করুন। ফিরে আসুন। আল্লাহ ক্ষমাশীল।

লিখেছেনঃ Abdul Ahad Rasel

source: facebook.com

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button
slot online skybet88 skybet88 skybet88 mix parlay skybet88 rtp slot slot bonus new member skybet88 mix parlay slot gacor slot shopeepay mix parlay skybet88 slot bonus new member